শহীদের রক্তে ভেজা স্বাধীন জন্মভূমি

29 August, 2018

শহীদ আলতাফ মাহমুদ, গেরিলা যোদ্ধা রুমি, বকর, হাফিজ বদি, জুয়েল, আজাদ। ১৯৭১ সালের ২৯, ৩০ ও ৩১ আগস্ট পাক বর্বরেরা তাদের ধরে নিয়ে যায় দেশি বেঈমানদের সহায়তায়। এই শহীদদের বীরত্বগাঁথায় একটু একটু করে জন্মেছে এই দেশ, গাঢ় সবুজের ভেতর টকটকে লাল রঙ্গের একটা বাঙল



ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে এইচএসসিতে স্ট্যান্ড করা অসম্ভব মেধাবী  ছাত্র বদিউল আলম একাত্তরে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ৪র্থ বর্ষের  ছাত্র, তবে সে পরিচয় ছাপিয়ে গিয়েছিল কুখ্যাত এনএসএফের গ্যাংস্টার হিসেবে  তার দৌর্দন্ড প্রতাপ... ৬৯'রের গনঅভ্যুত্থানই পাল্টে দিল সব, আরো অসংখ্য  তরুন-যুবার মত স্বাধীন বাংলাদেশের সযত্ন লালিত স্বপ্ন পাখা মেলতে থাকে বদির  ভেতর। একাত্তরের ২৫শে মার্চের বিভীষিকার পর নিরীহ বাঙ্গালীর তাজা  রক্তস্রোত পেরিয়ে পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে যোগদানের নিয়োগপত্র হাতে এসেছিল  ছেলেটার, ঘৃণাভরে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দিয়েছিল, বুকে ভেতর বাজছে  দামামা, যুদ্ধে যেতে হবে, ছিঁড়েখুঁড়ে আলাদা করে ফেলতে হবে পাকিস্তানী  শুয়োরগুলোকে, চোখ দুটো তার জ্বলছিল, ভাটার গনগনে আগুনের মত... বাবা আবদুল  বারী সাহেব টের পেয়েছিলেন সেটা, ছেলের মত নির্বিকারচিত্তে পাথরগলায় মা রওশন  আরাকে বললেন, তোমার তো ছয় ছেলে, একজনকে না হয় দেশের জন্য দিয়েই দিলে।"..
.
 ক্র্যাকডাউনের পর প্রথম যে চারজনের দলটা যুদ্ধ করতে ঢাকা ছাড়ে, তার মধ্যে  বদি ছিল অন্যতম। মেলাঘরে মেজর ক্যাপ্টেন হায়দারের হাতে ট্রেইন্ড সবচেয়ে  চৌকষ গেরিলাদের একজন বদি সহযোদ্ধাদের নিয়ে ঢাকায় পাকিস্তানীদের নাভিশ্বাস  তুলে ফেলে, অংশ নেয় ঢাকা শহর ও এর আশেপাশে বেশ কয়েকটি দুর্ধষ অপারেশনে।  এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো : ৮ আগস্ট ফার্মগেটে পাক বাহিনীর চেকপোস্ট  অপারেশন, ১৪ আগস্ট গ্যাস বেলুনের মাধ্যমে ঢাকা শহরের আকাশে বাংলাদেশের  অনেকগুলো পতাকা উড়ানো, ১৯ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনে  অপারেশন, ২৫ আগস্ট ধানমন্ডির ১৮ ও ২০ নম্বর রোডে অপারেশন। এসব অভিযান এখনও  তাদের দুর্ধর্ষতা ও দুঃসাহসিকতার উদাহরণ। ২৫শে আগস্ট অপারেশন ডেস্টিনেশন  আননোনের ধ্বংসযজ্ঞ এতটাই বেশি ছিল যে নপুংশক পাকিস্তানীরা পাগলা কুকুরের মত  আলবদর রাজাকারদের লেলিয়ে দেয় ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলাদের খুজে বের করার  জন্য। নিজামী-মুজাহিদের আলবদরের দেওয়া তথ্যে ২৯ আগস্ট ঢাকা কলেজের  প্রিন্সিপালের বাসা থেকে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পাকিস্তানী সেনাদের হাতে বদি  ধরা পড়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং নেবার রুট আর অস্ত্রের চালানের রুটটা  জানার জন্য ছেলেটার হাড়গুলো সব একটা একটা করে ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছিল,প্লায়ারস  দিয়ে তুলে নেওয়া হয়েছিল সবগুলো নখ, একটা শব্দও উচ্চারন করেনি ছেলেটা।

 শেষ পর্যন্ত যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে সুইচবোর্ডের সকেটের ভেতর আঙ্গুল  ঢুকিয়ে শক খেয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল সে, পারেনি। এক পাকিস্তানী হাবিলদার  পেটাতে পেটাতে তাকে সরিয়ে এনেছিল, ঝরঝর করে রক্ত ঝরতে থাকা মুখটা তুলে  বলেছিল, পাশের সেলে ওর বন্ধুরা তথ্য দিচ্ছে, ওরা মুক্তি পেয়ে যাবে, সেও যদি  তথ্যগুলো দেয়, তবে ছেড়ে দেওয়া হবে তাকে। ভাটার মত জ্বলছিল চোখদুটো, কণ্ঠে  অসম্ভব গাম্ভীর্য এনে প্রায় আধমরা ছেলেটা পাথরকঠিন গলায় বললো, "আমি কিছুই  বলব না, যা ইচ্ছা করতে পারো। ইউ ক্যান গো টু হেল..
৩১শে আগস্টের পর বদির আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। বদি আর কখনই ফিরে আসেনি...

 #আলতাফ_মাহমুদ:
 পাকিস্তান হবার পর প্রথম আঘাতটা এসেছিল ভাষার উপর, ছোট্টবেলায় মায়ের মুখে  শুনতে শুনতে যে মিষ্টি মধুর ভাষায় কথা বলতে শিখেছি আমরা, মাথামোটা  পাকিস্তানিগুলো সেই বাঙলাকে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল, চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল  উর্দু। বাঙলা মায়ের দামাল ছেলেরা বুকের তাজা রক্ত অকাতরে রাজপথে ঢেলে রক্ষা  করেছিল মায়ের ভাষার অধিকার, জন্মেছি সেই বিখ্যাত চরন, "আমার ভাইয়ের রক্তে  রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?" পরম যত্নে গভীর বিষাদমাখা  সুরের বাঁধনে বেঁধেছিলেন কথাগুলোকে, সৃষ্টি হয়েছিল এক অমর সঙ্গীতের।  প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারির দিনটায় খুব ভোরে উঠে প্রভাতফেরির সাথে হাঁটতে  হাঁটতে শহীদমিনার যেতেন, ঠোঁটের হারমোনিকায় বাজতো সেই কালজয়ী সুর...

 ৩৭০ নম্বর আউটার সার্কুলার রোডের বাসায় থাকতেন আলতাফ মাহমুদ। দুই নম্বর  সেক্টর গঠিত হলে তার বাসাটা পরিণত হয় মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম তীর্থে, অগণিত  মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়া, তাদের থাকা-খাওয়া, তাদের মেলাঘরের ঠিকানায়  পৌঁছে দেওয়া, আলতাফ মাহমুদ সবই করতেন। খালেদ মোশাররফের নির্দেশে শাহাদাৎ  চৌধুরী প্রায়ই আসতেন তার কাছে, স্বাধীন বাঙলা বেতার কেন্দ্রের গান রেকর্ড  করে তার হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিতেন আলতাফ। একদিন ক্র্যাক প্লাটুনের কয়েকজন এসে  বললেন, ঢাকায় প্রচুর পরিমানে আর্মস আনতে হবে, রাখার জায়গা নাই। তার বাসায়  রাখতে হবে। আলতাফ বিন্দুমাত্র দ্বিধা করলেন না, তার বাসা পরিনত হল এক  অস্ত্র-গোলাবারুদের বিশাল এক দুর্গে। এভাবে ঢাকা শহরে পাকিস্তানী  সেনাবাহিনীর আতংক হয়ে ওঠা ক্র্যাক প্লাটুনের অন্যতম প্যাট্রোনাইজার হয়ে  উঠলেন তিনি, জানতেন মাথার উপর মৃত্যু ঝুলছে… কিন্তু তিনি ভয় পাননি… ভয়  শব্দটা তার অভিধানে ছিল না…

 ৩০ শে আগস্ট ভোরে যখন পাকিস্তানী সেনারা মোটা শুয়োরের মত
 ঘোঁৎ ঘোঁৎ করতে করতে বাড়িতে ঢুকে গেল, চিৎকার করে বলতে লাগলো, মিউজিক  ডিরেক্টর কৌন হ্যায়, তখনো তিনি ভয় পাননি। নিশ্চিত মৃত্যুর সামনে শির উচু  করে বেরিয়ে এলেন বীর, ভোরের পবিত্র আলোয় তাকে যেন অপার্থিব লাগছিল, বুকটা  টান টান করে জবাব দিলেন, আমিই আলতাফ মাহমুদ, কি চাও তোমরা?
— হাতিয়ার কিধার হ্যায়?
 আলতাফ বুঝে গেলেন ওরা সব জেনেই এসেছে। তার মাথায় একটাই ভাবনা ঘুরতে লাগলো,  যেভাবেই হোক ক্র্যাক প্লাটুনের যোদ্ধারা(যারা তার বাসায় তখন ছিল), তার  পরিবার-পরিজন সবাইকে বাঁচাতে হবে। বললেন, এসো আমার সাথে। পাকিগুলো তার হাতে  কোদাল তুলে দিল, মাটি খুঁড়তে বললো। একটু দেরি হয়েছিল হয়তো, একজন রাইফেলের  বাট দিয়ে সাথে সাথে মুখে মারলো, আরেকজন বেয়োনেট চার্জ করলো। একটা দাঁত  ভেঙ্গে মাটিতে পড়ে গেল, কপালের চামড়া ফালাফালা হয়ে কেটে ঝুলতে লাগলো চোখের  উপর… সবাইকেই মারতে মারতে গাড়িতে তুলেছিল, ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে চালিয়েছিল  অকথ্য নির্যাতন। পৈশাচিকতার সব সীমা পেরিয়ে গিয়েছিল ওরা, কিন্তু ক্র্যাক  প্লাটুনের অন্য সবার মত আলতাফ মাহমুদের মুখ থেকেও একটা শব্দ বের করতে  পারেনি। আলতাফ মাহমুদ আর ফিরে আসেননি, উন্নত মম শিরের সেই অসামান্য বীরের  আর কখনো দেখা হয়নি তার ছোট্ট শাওনের মুখটা…

 #বকর:
 ৯ই জুলাই,১৯৭১ ঢাকা ইন্টারকন্টিনেন্টালে ক্র্যাক প্লাটুনের দুর্ধষ  গেরিলারা প্রথম অপারেশন চালিয়েছিল। বিখ্যাত সে অপারেশনের ছায়ায় ঢাকা পড়ে  গিয়েছিল ১১ আগস্ট দ্বিতীয় দফায় হোটেল্ ইন্টারকনে চালানো একটি মারাত্মক  বিস্ফোরণের গল্প। যার নেপথ্যে মূল নায়ক ছিলো ১৮ বছর বয়সী একটি ছেলে,  ক্র্যাকপ্লাটুনের সর্ব-কনিষ্ঠ গেরিলা - মোহাম্মদ আবু বকর । ঢাকা ইন্টারকনে  তাঁর সেই দুঃসাহসিক এ্যাকশনের খবর বিশ্ব গণমাধ্যমে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলৈা,  ভীত নাড়িয়ে দিয়েছিলো পাকিস্থানী মিলিটারীদের, তথাকথিত পৃথিবীর সেরা আর্মির  দাবিদার পাইক্কাদের দাম্ভিকতা পায়ের তলে পিষে সবচেয়ে সুরক্ষিত স্থানে হামলা  চালিয়ে স্বগৌরবে বের হয়ে এসেছিলো বকর।

 কেবল অপারেশনই নয়, পূর্ব  পাকিস্তানের আইএসআইয়ের বাঙ্গালী প্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন ইসলামকে শত্রুর চোখ  ফাকি দিয়ে পরিবারসহ পৌঁছে দিয়েছিল ভারতে নিরাপদ আশ্রয়ে। পাক  ইন্টিলিজেন্সের এই গুরুত্বপুর্ন কর্মকর্তাকে সঙ্গত কারনেই কঠোর নজরদারীতে  রাখতো পাঞ্জাবীরা, আর তাকেই মাসুদ রানা স্টাইলে রেসকিউ করে নিরাপদ আশ্রয়ে  নিয়ে এসেছিল দুই অকুতোভয় ক্র্যাক ফতেহ আলী চৌধুরী এবং আবু বকর। এরকম আরো  অনেকগুলো অপারেশনে পাকিস্তানীদের নাভিশ্বাস তুলে ছাড়ে বকর, বিশেষ করে ১১ই  আগস্টের অপারেশনের পর পাক মিলিটারি পাগলা কুকুর হয়ে গিয়েছিলো, এই দুঃসাহসী  যুবককে ৩০ আগস্ট ভোরে গুলশান-২ এর বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় পাক আর্মিরা ।  নাখালপাড়া ড্রাম ফ্যাক্টরী সংলগ্ন এম.পি হোস্টেলের বদ্ধ কামরায় অন্য  সহযোদ্ধাদের সাথে অমানুষিক নির্যাতন চলে এই গেরিলার উপর, সেদিনের পর বকরকে  খুঁজে পাওয়া যায়নি, বকর আর আর ফিরে আসেনি ...

 #হাফিজ
 শহীদ হাফিজ বেহালা বাজাতেন, আলতাফ মাহমুদের সাথে তার পরিচয়টাও সেই  সূত্রেই। ষাটের দশকের শুরুতে খুলনায় "ললিতকলা" নামে একটা গানের স্কুল  খুলেছিলেন হাফিজ , খুব একটা না জমায় জীবিকার তাগিদে চলে এলেন করাচী, সেখানে  বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক দেবু ভট্টাচার্যের সাথে কাজ করতে করতেই পরিচয় ঘটে  দেবুর এক গুনী শিষ্যের সাথে, পূর্ব বাংলায় যার পরিচিতি জনে জনে জানে,  -সুরকার আলতাফ মাহমুদ- যাঁর বিষাদমাখা সুরারোপে আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা  একুশের গানটি অমরত্ব লাভ করেছে বাঙ্গালী মানসপটে। ঈশ্বর ওঁদের জন্মতিথি  ভিন্ন ভিন্ন সময়ে লিখলেও, সেদিনের সেই পরিচয় ক্ষণে নির্ধারিত করে দিয়েছিলো  ওঁদের অভিন্ন অন্তিমতিথি ।

 হাফিজ কে আলতাফ মাহমুদের ছায়া সঙ্গী বলে  ডাকা হত। একাত্তরের যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের  জন্য নতুন গান প্রয়োজন। নতুন গান করার বিষয়ে আলোচনার জন্য তিনি একদিন  হাফিজকে সাথে নিয়ে চলেন গেলেন গণসংগীত শিল্পী আব্দুল লতিফ সাহেবের বাসায়,  তিন গানের জগতের মানুষ সুর-স্বর-স্বরলিপি সমন্বয়ে মুক্তিযুদ্ধকে চাঙ্গা  রাখতে অনেকক্ষণ সময় নিয়ে বৈঠক করলেন। কেবল সেখানেই নয়, বৈঠক চলতো ৩৭০ আউটার  সার্কুলার রোডের বাসাতেও, আব্দুল লতিফ সাহেব ও আলতাফ মাহমুদ দৃজন মিলে  ঘন্টার পর ঘন্টা পার করে দিতেন, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্যে গান  লিখবার তাড়নায় ক্লান্তির কথা তাদের মাথাই আসতো না। বেহালার সাথে সাথে  প্রয়োজনে গেরিলা অপারেশনেও সমান পারদর্শিতা দেখিয়েছেন এই সাহসী যোদ্ধা। ৩০  অগাস্ট পাক সেনাদের হাতেও তাঁরা একসাথে ধরা পরেন। অস্ত্র আর মুক্তির খোঁজে  পাকি পশুরা এমনই অত্যাচার চালিয়েছিল তার উপর যে হাফিজের চোখ কোটর থেকে  ছিটকে বেরিয়ে গিয়েছিল... তবুও তথ্য তো দূরে থাক, একটা টু শব্দও করেননি এই  অমিত সাহসী বীর! টর্চার সেলেই ৩১ অগাস্ট রাতে মৃত্যু বরন করেন তিনি।

 #জুয়েল
 দুর্ধর্ষ মারকুটে ব্যাটসম্যান ছিল ছেলেটা, ব্যাট হাতে মাঠে নামার পর  বোলারদের নাকের জল চোখের জল এক হয়ে যেত। আজাদ বয়েজ ক্লাবের হয়ে ওপেনিংয়ে  নামতো, ৪৫ ওভারের ম্যাচ। টর্নেডো বইয়ে দিত একেবারে, ধুমধাড়াক্কা বাইড়ানির  চোটে বিপক্ষ দল চোখে অন্ধকার দেখত, নাকের জল-চোখের জল এক হয়ে যেত বোলারদের,  বলের লাইন-লেন্থ কোথায় উড়ে যেতো ! স্লগ সুইপটা অসাধারন খেলত, বল জিনিসটা  যে পেটানোর জন্য, এইটার সবচেয়ে বড় উদাহরন ছিল ওর ব্যাটিং। করাচীর লীগের এক  ম্যাচে একদিন ওর তুমুল মার দেখতে দেখতে এক পাঞ্জাবী কোচ সবিস্ময়ে বলে উঠলো,  এই ছেলে এইখানে কেন? ওর তো ন্যাশনাল টিমের হয়ে ওপেনিং করার কথা...
কথাটা খুব সত্য ছিল, কিন্তু অবাস্তব সত্য। ছেলেটা বাঙ্গালী, আর পাকিস্তান  নামক এই পোকায় কাটায় রাষ্ট্রটায় বাঙ্গালীর অবস্থান ছিল কুকুরের চেয়েও  নিকৃষ্ট, গোলামেরও চেয়েও অধম। ছেলেটার স্বপ্ন ছিল আকাশছোঁয়া, ছেলেটা  ন্যাশনাল টিমের হয়ে ওপেনিং করার স্বপ্ন দেখতো। স্বাধীন বাংলাদেশ দলের  ওপেনিং করবার স্বপ্ন...
১৯৭১ সালের ২৭শে মার্চ জেলা ক্রীড়া ভবনের সামনে  সদাহাস্যজ্বল মুশতাক ভাইয়ের দু হাত উপরে তলা ডেডবডিটা পড়ে ত্থাকতে দেখার  পর ছেলেটার স্বপ্নটা একটা ধাক্কা খেল। নিষ্প্রাণ ঝাঁজরা দেহটা পড়ে আছে  খোলা আকাশের নিচে। হাতদুটো উপরে ধরা। আজাদ বয়েজ ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা মুশতাক  ভাইয়ের আপন শত্রুও এই অপবাদ দিতে পারবে না যে, তিনি কাউরে কোনোদিন একটা  গালি দিয়েছেন। ক্রিকেট ছিল তার ধ্যান, একমাত্র সাধনা। বিনা অপরাধে এইভাবে  মরতে হবে, মৃত্যুর আগমুহূর্তেও হয়তো এটা তার কল্পনাতেও ছিল না। মুশতাক  ভাইয়ের সেই দৃষ্টি ছেলেটার মাথায় গেঁথে গেল, ব্যাট ফেলে তুলে নিল স্টেনগান,  পাকি শুয়োরগুলারে মারতে হবে, দেশটারে স্বাধীন করতে হবে…

 প্রথমে  বাঁধা হয়ে এসেছিল স্নেহময়ী মা। ছোটবেলা থেকে যক্ষের ধনের মত আগলে রাখা  মায়ের চোখকে ফাকি দিয়ে মে'র ৩১ তারিখ বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায়  ছেলেটা। প্রতিপক্ষের বোলারদের এতটুকু চড়াও হতে না দেওয়ার মানসিকতা যার,  অ্যাটাক ইজ দা বেস্ট ডিফেন্স ছিল যার মুলমন্ত্র, সে কিভাবে নিজেকে ঘরে আটকে  রাখবে? তাই দেশমাতা সম্ভ্রম রক্ষায় বেরিয়ে গিয়েছিল ও, যাবার কদিন আগে মাকে  একটা চিঠি দিয়ে বলেছিল, "আমি যখন থাকবো না, এই ছবিটাতে তুমি আমাকে দেখতে  পাবে।"

 দুই নম্বর সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল খালেদ মোশাররফের  নির্দেশে গেরিলা ওয়ারফেয়ারের কিংবদন্তী মেজর এটিএম হায়দার ১৭ জন তরুনকে  গেরিলাযুদ্ধের ট্রেনিং দিয়ে ঢাকায় অপারেশনে পাঠান। এরাই পরবর্তীতে  পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অকল্পনীয় ত্রাস "ক্র্যাক প্লাটুন" এ পরিনত হয়।  ছেলেটা এই ১৭ জনেরই একজন ছিল। সিদ্ধিরগঞ্জ অপারেশনের রেকি করতে গিয়ে  রামপুরা বিলে পাকিস্তানি সেনাদের ব্রাশফায়ারে ডান হাতের তিনটা আঙ্গুল  ভেঙ্গে গর্ত হয়ে গিয়েছিল ছেলেটার। হাতটাকে পচনের হাত থেকে বাঁচাতে  আঙ্গুলগুলা কেটে ফেলতে হবে, হঠাৎ ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে করুন স্বরে  আর্তি জানাল ছেলেটা, "দেশ স্বাধীন হইলে আমি ন্যাশনাল টিমের হইয়া ওপেনিংয়ে  নামুম, ক্যাপ্টেন হমু। আঙ্গুল তিনটা রাইখেন স্যার, প্লিজ…"
২৯ শে আগস্ট  ছেলেটা মগবাজারে আজাদের বাসা আহতাবস্থায় আজাদ, বাদলসহ আরও কয়েকজনের সাথে  ধরা পড়ে ও। ধরা পড়ার সময় ব্যান্ডেজে মোড়া ভাঙ্গা আঙ্গুলগুলো তিনটা যখন মোচড়  দিচ্ছিল পাকি ক্যাপ্টেন, তখনো স্বপ্নটা ছেলেটাকে ঘিরে ছিল। টর্চার সেলে  আঙ্গুলগুলোর উপর হাতুড়ির বাড়ি পড়তো প্রতিদিন নিয়ম করে, প্ল্যায়ার্স দিয়ে  মুচড়ে ধরে জিজ্ঞেস করতো শুয়োরগুলো, "মুক্তি কা রুট কিধার হ্যায়, হাতিয়ার  কাহা সে আ রাহা," অচিন্তনীয় যন্ত্রনায় কাতরাতে থাকা ছেলেটাকে তখনো তার  স্বপ্নটা ছেড়ে যায়নি। স্বপ্ন বোধহয় বড্ড ভালোবেসে ফেলেছিল ছেলেটাকে...
ক্রিকেটমাঠে জীবনের শেষ ইনিংসে ছেলেটা অপরাজিত ছিল, অপরাজিত ছিল তিনটা  আঙ্গুল ভেঙ্গে যাওয়ার পরেও। ভাঙ্গা আঙ্গুল তিনটা বুটের নিচে পিষে ফেলার সময়  অমানুষিক যন্ত্রণা হচ্ছিল, কিন্তু ছেলেটা হেরে যায়নি। কাহা সে ট্রেনিং  লেকে আতা তুম লোগনে, কিধার সে আর্মস আতা প্রশ্নগুলো সহস্রবার করেছে পাকি  হায়েনারা, উত্তর না পেয়ে আঙ্গুলের পর বেয়নেট দিয়ে একটু একটু করে ফালা ফালা  করেছে ছেলেটার শরীরটা, ছেলেটা হেরে যায়নি। চিৎকার করেছে, যন্ত্রণায় জ্ঞান  হারিয়ে ফেলেছে, মা মা বলে ডেকেছে আকুতিভরে, তবুও একটা কথাও বলেনি সে। তার  সহযোদ্ধাদের পরিচয়, অস্ত্রের চালান কিংবা ট্রেনিংয়ের রুট, কিছুই বলেনি।  নিশ্চিত মৃত্যুর সামনেও অপরাজিত ছিল ছেলেটা, মাথা উঁচু করে, বুকটা ফুলিয়ে,  হেরে যাওয়াটা যে তার অভিধানে ছিল না...
ছেলেটা আর ফিরে আসেনি। ছেলেটার  নাম ছিল জুয়েল,আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল... নতুন প্রজন্মের সন্তানদের কাছে  "উনিশশো কটকটি সালের ইতিহাস" হয়ে যাওয়া যার ক্ষতবিক্ষত লাশের উপর তবু  দাড়িয়ে আছে একটা স্বাধীন দেশ, যার বুকের টকটকে রক্তস্রোত জমাট বেঁধে আছে  একটা দেশের পতাকায়, সবুজ জমিনের ঠিক মাঝখানে... গর্বে... অসম্ভব গর্বে....

 #রুমি
 আম্মা,দেশের এই রকম অবস্থায় তুমি যদি আমাকে জোর করে আমেরিকা পাঠিয়ে  দাও,আমি হয়তো যাবো শেষ পর্যন্ত।কিন্তু তাহলে আমার বিবেক চিরকালের মত অপরাধী  করে রাখবে আমাকে।আমেরিকা থেকে হয়ত বড় ডিগ্রি নিয়ে এসে বড় ইন্জিনিয়ার  হবো,কিন্তু বিবেকের ভ্রূকুটির সামনে কোনদিন ও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবনা  ।তুমি কি তাই চাও আম্মা ?”
“জননী তার জোরে দুই চোখ বন্ধ করে বললেন “না  ,তা চাই নে ।ঠিক আছে তোর কথাই মেনে নিলাম।দিলাম তোকে দেশের জন্য কোরবানি  করে ।যা,তুই যুদ্ধেই যা।”
জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত আম্মা আফসোস  করতেন, কেন তিনি কোরবানি শব্দটা ঊচ্চারন করেছিলেন... হয়তো সে কারনেই আর তার  আদরের ধন ফিরে এল না। মায়ের মন... আহারে...
উপরের সংলাপগুলো কাল্পনিক  নয় ,কোন সংলাপ বুদবুদে ভাসা আবেগের আতিশয্য নয়,সত্য গল্প নয় ,গল্পের মত  সত্য,কোন এক অলৌকিক উপায়ে হয়ে যাওয়া আমাদের সবার গল্প।
ভাষা আন্দোলনের  আগের বছরের ২৯ মার্চ ছেলেটির জন্ম।রুমী খুব সহজে পৃথিবীতে আসেনি দীর্ঘ ১৪  ঘন্টা গর্ভধারনিকে কষ্ট দিয়ে নিজেও কষ্ট পেয়ে ২৯ মার্চ বৃহস্পতি বার দুপুর  সাড়ে বারোটায় সে পৃথিবীর আলো দেখেছিলো। সেসময়ের উচ্চবিত্ত পরিবারের একজন  বাঙালি সন্তানের মতই ছিল।গড়নে সব সময় পাতলা পোশাক,পরিচ্ছেদে  পরিপাটি,চেহারার আভিজাত্যবোধ কিন্তু নীতিনিষ্ঠ রুমী জীবনে সব ভালো কিছুর  প্রতি আগ্রহী ছিলেন।১৯৭০ সালে যখন ঘূর্ণিঝড়ের পরেই রুমীর বাহ্যিক পরিবর্তন  দেখা গিয়েছিলো।দুর্গত মানুষের পাশে দাড়াতে রুমী ছুটে গিয়েছিলেন দেশের দিক  থেকে দিগন্তে।
তারপর দেশে একাত্তর এলো,এলো মার্চ।১লা মার্চ যখন ইয়াহিয়া  অধিবেশন বানচাল করার ঘোষণা দিলো রেডিও তে সেই রুমীই ঢাকা স্টেডিয়ামে চলতে  থাকা ক্রিকেট ম্যাচ বাদ দিয়ে চলে এসেছিল বটতলায়,পরবর্তী করনীয় কি হবে  জানতে। আবার মুহুতেই বন্ধুর মোটর বাইকের পিছনে চড়ে গায়েব হয়ে গিয়েছিলেন  আন্দোলনের ঢাকার খবর জানতে। খেতে ভালবাসতো যে ছেলেটি, সেদিন মায়ের হ্যাম  বার্গারের কথাও ভুলে গিয়েছিল সে দেশের জন্য।৭মার্চের ভাষন শুনে বাড়ি ফিরে  মাকে চোখ বড় বড় করে সে গল্প শুনিয়েছিল সে। তবে হতাশ গলায়। আশাহত রুমী যুদ্ধ  চাইছিলো।
"আম্মা বুঝতে পারছ না মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনা ব্যর্থ হতে  বাধ্য।এটা ওদের সময় নেবার অনুহাত মাত্র ওরা আমাদের স্বাধীনতা  দিবেনা।স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে হবে সশস্ত্র সংগ্রাম করে।"

 কথাটা রুমী  বলেছিলেন যুদ্ধ শুরু হবার আগে।চে গুয়েবারার ভক্ত আর মাও সে তুং নখদর্পনে  নিয়ে ফেলা রুমী ঠিকই বুঝতে পেরেছিলো কি হতে যাচ্ছে আর আমাদের কি করতে হবে।

 বেঁচে থাকতে শেষ জন্মদিনটা,৭১ এর শেষ জন্মদিনটা ভালো কাটেনি রুমীর।যে পিতা  নেপথ্যে থেকে পুত্রকে স্বাধিকার আন্দোলনের শরিক করলেন এবার তিনি বেড়িয়ে  এলেন প্রকাশ্যে।স্ত্রী কে সাথে নিয়ে পুত্রের ২০ তম জন্মদিনে তাঁকে উৎসর্গ  করে দিলেন দেশের জন্য।জন্মদিনে রুমীকে তার বাবা শরীফ ইমাম ও মা জাহানারা  ইমাম একটি চিঠি লেখেন,যেটাতে লেখা ছিলো

 "চারিদিকে বাগিনীরা ফেলিতেছি  বিষাক্ত নিঃশ্বাস শান্তির ললিতকনা শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস।এই অশুভ সময়ে  তোমার শুভ জন্মদিনে তাই,চিরাচারিত যে বলবো না বড় হও,সফল হও,সুপ্রষ্ঠিত  হও।তা উচ্চারণ করতে পারবো না তার বদলে মাল্যধর্নি উচ্চারণ করছিঃ ব্রজের মত  হও,দীপ্ত শক্তিতে জেগে উঠো দেশের অপমান দূর করো। দেশবাসীকে তার যোগ্য  সম্মানের আসনে বসাবার দুরহ ব্রতে জীবন উৎসর্গ করো।"

 ইতি তোমার আব্বু ও আম্মু
 ১৯৭১ সালের ১৯ এপ্রিল মা কে রাজি করিয়ে ২ মে রুমী সীমান্ত অতিক্রমের  প্রথম প্রয়াস চালান।কিন্তু প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে তাঁকে ফেরত আসতে হয়  এবং দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় সফল হন।পড়েছিল কে ফোর্সের খালেদ মোশাররফের হাতে।  খালেদ মোশাররফ ক্যাপ্টেন হায়দারের হাতে তুলে দেন রুমীদের।একজন রুমীর বীর  রুমী হয়ে ওঠার পেছনে ক্যাটেন হায়দারের অবদান বোধহয় সবচেয়ে বেশী,ট্রেনিং  শেষে রুমীর অবদান নতুন করে বলা হয়তো লাগে না কারণ তারপরের তার জীবনের  প্রতিটি পরিচ্ছেদ হয়ে আছে মহাকাব্যের অংশ হয়ে আছে বাংলাদেশের সোনালী  ইতিহাসের পাতায় পাতায়।

 মেলাঘর থেকে ট্রেনিং নিয়ে আসবার পর জুয়েল,  বদি, আলম,মায়া, কাজী কামালদের সাথে রুমিও ঢাকায় পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে  অপারেশনে যোগ দেয়। এর মধ্যে আগস্টের ২৫ তারিখে ধানমন্ডি্র বিভিন্ন রোডে  মোবাইল টার্গেটে অপারেশন ডেস্টিনেশন আননোনে রুমির অভাবিত বীরত্বগাঁথা  তোলপাড় তোলে শহর জুড়ে। অপারেশন সেরে ফিরে আসার সময় স্রেফ রুমির  প্রত্যুতপন্নমতিতা এবং চোখের পলকে ফায়ারিংয়ে সেদিন উল্টে যায় পিছু ধাওয়া  করে আসা পাকিস্তানী সেনাদের একটা জীপ। পাকিস্তানিরা সম্মুখীন হয় অচিন্তনীয়  ক্ষতির। মার কাছে সে গল্প করতে গিয়ে রুমি বলেছিল,
//আম্মা দেখো আমার  ঘাড়ে কাধে স্টেন গান থেকে আগুনের ফুলকি ছুটে কি রকম ফোসকা পড়ে গেছে রাস্তায়  মিলিটারী ধরলে এইটার জন্যই ফেসে যাব।//

 কে জানতো দুদিনের মাথায়  রুমির মুখের কথাটাই সত্য হয়ে যাবে। ২৯শে আগস্ট রাতে পাকিস্তানী সেনাদের  সাঁড়াশী অভিযানে ধানমন্ডির কনিকা থেকে ধরা পড়ে রুমি, সাথে ধরে নিয়ে যাওয়া  হয় বাবা শরীফ ইমাম, ভাই জামী, খালাতো ভাই মাসুম সহ কয়েকজনকে। ক্র্যাক  প্লাটুনের বাকি সহযোদ্ধাদের সাথে অকথ্য নির্যাতন চলে তাদের উপর। উনিশ বছর  বয়েসী রুমি বাবা আর ভাইসহ সবাইকে বলে দিয়েছিল, কেউ যেন কোন কথা না বলে।  নিজের ঘাড়ে সকল দায় নিয়ে বাকি সবাইকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল ও। অকথ্য অবর্ননীয়  নির্যাতনের মুখেও একটা তথ্যও দেয়নি, ঠাণ্ডা গলায় বলেছিল, “You people are  going to die. You can’t flee, you can’t leave-Nobody can save you- I can  tell you this much”

 রুমীকে ছাড়িয়ে আনার জন্য অনেকেই রুমীর বাবাকে  ইয়াহিয়ার নিঃশ্বর্ত ক্ষমার সুযোগ নিতে বলেছিলেন। কিন্তু রুমীর ধমনীতে যে  তার বাবার রক্ত। ছেলেকে আর কখনো ফিরে না পাবার নির্মম বাস্তবতা বুকে চেপে  বাবা শরীফ ইমামও পাক হানাদার সরকারের কাছে মাথা নিচু করতে অস্বীকৃতি  জানিয়েছিলেন।প্রাণভিক্ষা চাননি ,চান নি এতটুকু করুণা ।এ এমন পিতার গল্প  যিনি শত অপমান বেত্রাঘাতেও টলেননি এতটুকু।এ এমন জননীর গল্প যিনি খলীল  জিবরানের প্রফেট থেকে লাইন আউড়ে মনকে শক্ত করেছেন,পুরো পরিবার যেন  নীলকণ্ঠ।পুরাণে এক দেবতা বিষ নিজের গলায় ধারণ করে বাঁচিয়েছিল বিশ্ব,নিজে  হয়েছিল নীলকণ্ঠ।এই পরিবার ,এই গল্প,এই পিতা পুত্র জননীরাও যেন তাই।আমরা  দুর্ভাগ্যবান তাদের নষ্ট বীজ আজো বিষবৃক্ষ ছড়িয়ে দিচ্ছে শ্যামল বাঙলায়,যার  জন্য গল্পের জননীকে,আমাদের জননীকে পেতে হয় রাষ্ট্রদ্রোহীর অভিধান।এরচেয়ে বড়  জঘণ্য অনাচার পৃথিবীতে আর কি হতে পারে?

 ধরা পড়ার আগের কোলে মাথা  রাখা রুমিকে মা বলেছিলো কত বয়স তোর।পৃথিবীর কিছুই তো দেখলি না,জীবনে কিছুই  তো জানলিনা।রুমী মুখ তুলে কি একরকম যেন হাসি হাসল,মনে হলো অনেক বেদনা সে  হাসিতে।একটু চুপ থেকে বললো,
বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন একটা কথা আছে না  আম্মা হয়তো জীবনের পুরোটা তোমাদের মত জানি না,ভোগও করিনি কিন্তু জীবনের যত  রস-মাধুর্য-তিক্ততা সব কিছুর স্বাদ আমি এর মধ্যেই পেয়েছি আম্মা।যদি চলেও  যাই কোন আক্ষেপ নিয়ে যাবো না ।"
রুমি আর ফিরে আসেনি। কখনো না।

 #আজাদ
 “চাচি, আল্লাহর কাছে শোকর করেন। আমি আছি বইলাই আজাদরে ছাইড়া দেওয়ার একটা  সুযোগ আইছে। উনারে ক্যাপ্টেন সাব পাঠাইছে। কি কয় মন দিয়া শুনেন।“
সাদা  শার্ট-কালো প্যান্ট পড়া আর্মি ছাটের কাটা চুলের মানুষটা সাফিয়া বেগমের দিকে  ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। তার গলার স্বরটা ততধিক ঠাণ্ডা শোনায়,
–আজাদের সাথে দেখা করতে চান?
–জি।
–ছেলেকে ছাড়ায়ে আনতে চান?
–জি!
–আজকে রাতে আজাদকে রমনা থানায় নিয়ে আসবে। দেখা করায়া দিব ওর সাথে। বুঝলেন?
–জি।
–তার সাথে দেখা করবেন। দেখা করে বলবেন, সে যেন সবার নাম বলে দেয়। অস্ত্র কোথায় রেখেছে, তা বলে দেয়।
–জি?
–সে যদি সব বলে দেয়, তাকে রাজসাক্ষী বানানো হবে। ছেলেরে যদি ফিরে পাইতে চান, তারে সব বলতে বলবেন।
আজাদের মা লোকটার পাথুরে মুখের দিকে তাকান। তার চোখে নিঃস্পন্দ শুন্য দৃষ্টি…
 গরাদের ওপারে দাড়িয়ে থাকা আজাদকে তার মা চিনতে পারেন না। প্রচণ্ড মারের  চোটে চোখমুখ ফুলে গেছে, ঠোঁট কেটে ঝুলছে, ভুরুর কাছটা কেটে গভীর গর্ত হয়ে  গেছে।
–“মা, কি করব? এরা তো খুব মারে। স্বীকার করতে বলে সব। সবার নাম বলতে বলে।“
–“বাবা, তুমি কারোর নাম বলোনি তো?
–না মা, বলি নাই। কিন্তু ভয় লাগে, যদি আরও মারে, যদি বলে দেই…
–বাবারে, যখন মারবে, তুমি শক্ত হয়ে থেকো। সহ্য করো। কারো নাম বলো না।
–আচ্ছা মা। ভাত খেতে ইচ্ছে করে। দুইদিন ভাত খাই না। কালকে ভাত দিয়েছিল, আমি ভাগে পাই নাই।
–আচ্ছা, কালকে যখন আসব, তোমার জন্য ভাত নিয়ে আসব।
 সাফিয়া বেগমের ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে যায়। গায়ে হাত তোলা তো দূরে থাক, ছেলের  গায়ে একটা ফুলের টোকা লাগতে দেননি কোনোদিন। সেই ছেলেকে ওরা এভাবে মেরেছে…  এভাবে…
মুরগির মাংস, ভাত, আলুভর্তা আর বেগুনভাজি টিফিন ক্যারিয়ারে ভরে  পরদিন সারারাত রমনা থানায় দাড়িয়ে থাকেন সাফিয়া বেগম, কিন্তু আজাদকে আর  দেখতে পাননি। তেজগাঁও থানা, এমপি হোস্টেল, ক্যান্টনমেন্ট-সব জায়গায় খুজলেন,  হাতে তখন টিফিন ক্যারিয়ার ধরা, কিন্তু আজাদকে আর খুঁজে পেলেন না।
ক্র্যাক প্লাটুনের বাকি সদস্যদের মত আজাদকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
 ১৯৮৫ সালের ৩০শে আগস্ট মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সাফিয়া বেগম আর কখনো বিছানায়  শোননি... শক্ত মেঝেতে মাথার নিচে একটা ইট দিয়ে ঘুমিয়েছেন... কারন নাখালপাড়া  ড্রাম ফ্যাক্টরী সংলগ্ন এম.পি হোস্টেলের মিলিটারি টর্চার সেলে তার ছেলেকে  তিনি মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখেছিলেন, কাঁটাছেঁড়া শরীরে কোনরকমে পড়ে থাকা... আর  একটাবারের জন্যও কোনোদিন ভাত মুখে তোলেননি সাফিয়া বেগম, বেঁচে থাকার জন্য  রুটি খেয়েছেন, পানি দিয়ে ভিজিয়ে পাউরুটিও খেয়েছেন কখনও, কিন্তু ভাত না। তার  আজাদ যে ভাত খেতে চেয়েও ভাত খেতে পায়নি…
আহারে মা, আহারে ভাত...

 ফেসবুক আর ইউটিউব দেখে দেখে এই প্রজন্মের যারা দেশি বিদেশি নানা  মোটিভেশনাল স্পিকারের নাম জানে তারা কী রুমি, বকর, হাফিজ বদি, জুয়েল,  আজাদের নামগুলো জানে? ওরা মোটিভেশনাল স্পিকার ছিলো না কেউ, ছিলো একেকটা  বারুদ, যারা জীবন দিয়ে দেখিয়ে গেছে দেশের জন্য কতোটা উৎসর্গ করা যায়।  জানা উচিত। আজ সকালটা শুরু করছি তাদের শ্রদ্ধা জানিয়ে। কারণকারণএই অসামান্য  বীরদের অমিত বীরত্বগাঁথায় একটু একটু করে জন্মেছে এই দেশ, গাঢ় সবুজের ভেতর  টকটকে লাল রঙ্গের একটা বাঙলাদেশ... শহীদের রক্তে ভেজা স্বাধীন জন্মভূমি...

 _______________________________________

 কৃতজ্ঞতা: Shawan Mahmud
কাভারফটো- Saifur R. Mishu
রাইটআপ- Rahman Raad


মন্তব্য লিখতে লগইন অথবা রেজিস্ট্রেশন কর