ক্র্যাক প্লাটুন- তোমাদের এই ঋণ কোনদিন শোধ হবে না!

29 August, 2018

ক্র্যাক প্লাটুন- তোমাদের এই ঋণ কোনদিন শোধ হবে না!



২৯ আগস্ট, ১৯৭১; ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর জালাল উদ্দিনের বাসায় বদি, পারভেজ আর ফরিদরা বসে তাস খেলছিল। সময় তখন রাত এগারোটা। কিছুদিন আগে করা ধানমণ্ডি অপারেশনের স্মৃতি তখনো বিস্মৃত হয়নি। পুরো ঢাকাজুড়ে ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যদের পাগলের মতো খুঁজছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীরা। কিছুদিনের মাঝেই ঢাকায় পাকিস্তানি হানাদারদের নাকের জল-চোখের জল এক করে দিয়েছে ক্রাক প্লাটুনের সদস্যরা। জালাল উদ্দিনের ধানমণ্ডি বাসা থেকে কিছুক্ষনের জন্য বের হন জালাল উদ্দিনেরই ছেলে ফরিদ। আধঘন্টা পর জালাল উদ্দিনের বাসার চারপাশে ভারী যানবাহনের শব্দ, দরজায় কড়াঘাত শোনা যায় জোরে জোরে। পাকবাহিনীর সদস্যরা ক্র্যাক প্লাটুনের দুর্ধর্ষ যোদ্ধা বদিউল আলমকে ধরার জন্য পুরো এলাকা ঘিরে ফেলেছে। বদি জানালা দিয়ে পালানোর চেষ্টা করলেও লাভ হয় নি। ফরিদের দেয়া তথ্যানুযায়ী বদিকে ধরে ফেলে পাকবাহিনী। বদিকে ধরার পরপরই পাকিস্তানি হানাদারেরা শুরু করে অকথ্য নির্যাতন। তবুও ক্র্যাক প্লাটুনের অন্য কোন সদস্যের নাম মুখে থেকে বের করতে পারেনি তার। কিন্তু ফরিদকে নির্যাতন শুরু করতেই ফরিদ একে একে বলে দেয় আবদুস সামাদ, চুল্লুর নাম। একে একে ধরা পড়তে থাকে ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যরা। রুমী,আজাদ, বকর, জুয়েল, হাফিজ ও আলতাফ মাহমুদরা আটক হতে থাকেন একের পর এক।

ক্র্যাক প্লাটুন, নামটা দেয়া হয়েছিল এই প্লাটুনের ক্র্যাক মেন্টালিটি দেখেই। দেশের প্রধান শহর শান্তিপূর্ণ রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থাই নিয়েছিল পাকবাহিনীরা। আর দেশি-বিদেশি মিডিয়ার যুদ্ধাবস্থা বোঝার জন্য মূল অনুসন্ধানটাই শুরু হতো ঢাকা থেকে। বিশ্ব মিডিয়ায় শোরগোল তোলার জন্য ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে অবস্থানরত বিদেশী সাংবাদিকদের তাই জানানো দরকার ছিল সমগ্র দেশের অবস্থা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই দলটি গঠনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন খালেদ মোশাররফ বীরউত্তম এবং এ টি এম হায়দার বীরউত্তম। এটি ২নং সেক্টরের অধীন একটি স্বতন্ত্র গেরিলা দল, যারা মূলত গণবাহিনীর অংশ বলে পরিচিত। এই বাহিনীর সদস্যরা ভারতের মেঘালয় প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এই প্রশিক্ষণে গ্রেনেড ছোড়া, আত্মগোপন করা প্রভৃতি শেখানো হয়।

খালেদ মোশাররফের নির্দেশেই দুঃসাহসী এই তরুণরা অত্যন্ত ঝুঁকির সঙ্গে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বোমা হামলা করে বেশ কয়েকজন পাক হানাদারকে হত্যা করে। সন্ধ্যায় বিবিসির খবর থেকে খালেদ মোশাররফ এই অপারেশনের কথা জানতে পেরে বলেন, ‘দিজ অল আর ক্র্যাক পিপল।’ তিনিই প্রথম এই দলটিকে ক্র্যাক আখ্যা দেন; যা পরবর্তীতে ক্র্যাক প্লাটুন নামে পরিচিত হয়। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ‘হিট এন্ড রান’ পদ্ধতিতে অসংখ্য আক্রমণ পরিচালনা করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মধ্যে ব্যাপক ত্রাসের সঞ্চার করে।

পাঁচ-ছয় জনের এক একটি দল তৈরি করে এই গেরিলা দলটি অপারেশনে অংশ নিত। ঢাকা শহরে তারা মোট ৮২টি অপারেশন পরিচালনা করেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হলো- অপারেশন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, অপারেশন গ্যানিজ পেট্রল পাম্প, অপারেশন দাউদ পেট্রল পাম্প, অপারেশন এলিফ্যান্ট রোড পাওয়ার স্টেশন, অপারেশন যাত্রাবাড়ী পাওয়ার স্টেশন, অপারেশন আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন, অপারেশন সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন, অপারেশন উলন পাওয়ার স্টেশন, অপারেশন ফার্মগেট চেক পয়েন্ট, অপারেশন তোপখানা রোড ইউএস ইনফরমেশন সেন্টার, এটাক অন দ্য মুভ প্রভৃতি।

বদিসহ ক্র্যাক প্লাটুনের অনেক সদস্যই আর বাড়ি ফেরেন নি কখনো। নির্যাতনের চূড়ান্ত রূপ তাদের সাথে দেখিয়েছিল পাক হানাদাররা। কাকে কবে হত্যা করা হয় তা নিয়ে কোন তথ্য পাওয়া যায় নি। তবে বদির সহযোদ্ধা মনুর কাছ থেকে জানা যায় ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যদের ওপর পাকিস্তানিদের নির্যাতনের মাত্রা।

বদিউল আলম আর মনু বন্দী ছিলেন পাশাপাশি সেলে। ঘটনাচক্রে তিনি পালিয়ে আসতে সক্ষম হন। মনু জানান, সেনাদের নির্যাতনে শহীদ বদিউল আলমের একটি হাতের জয়েন্ট খুলে যায় এবং হাড় ভেঙে ঝুলে গিয়েছিল, একটি চোখ প্রায় অক্ষি কোটর থেকে বেড়িয়ে এসেছিলো। মনুরও পা ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। বন্দি শিবিরে ভয়ংকর নির্যাতনের শিকার হয়েও ঠাণ্ডা গলায় শহীদ বদিউল আলম বলেছিলেন, “আমি কিছুই বলব না, যা ইচ্ছা করতে পারো। You Can Go to Hell” ।
বদি, রুমিসহ ক্র্যাক প্লাটুনের সকল সদস্যরা ছিল আগুনের মতো। যাদের হলকায় পাকিস্তানিরা টের পেয়েছিল প্রথম এই দেশ শোষণ করা আর তাদের পক্ষে সম্ভব না। সেই আগুনের পরশমণিদের আজও আমরা স্মরণ করতে চাই শ্রদ্ধাভরে। তোমাদের এই ঋণ কোনদিন শোধ হবে না...


মন্তব্য লিখতে লগইন অথবা রেজিস্ট্রেশন কর