বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান স্মরণে

17 November, 2018

বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান।



 স্বাধীনতা উত্তরকালে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতাপূর্ণ অবদানের জন্য কারা বিভিন্ন খেতাবে ভূষিত হয়েছিলেন সে বিষয়টি অনেকেই জানতেন না। প্রথমদিকে এ নিয়ে কেউ উচ্চবাচ্যও করেননি। মুক্তিযুদ্ধে যে অকুতোভয় মানুষেরা প্রাণ দিয়েছিলেন তাদের আত্মত্যাগের কাহিনী সংবাদপত্রের পাতায় সাফল্যের সঙ্গে প্রথম তুলে ধরে দৈনিক বাংলা। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত সাতজন শহীদই ছিলেন স্থল, নৌ,  বিমানবাহিনীর এবং আধা-সামরিক বাহিনী বাংলাদেশ রাইফেলসের সদস্য। মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া এই মানুষগুলো সম্পর্কে শুরুর দিকে দেশের মানুষ প্রায় কিছুই জানতেন না।

বীরশ্রেষ্ঠদের জীবন ও গৌরবের কাহিনী সর্বপ্রথম জনসম্মুখে নিয়ে আসে সাপ্তাহিক বিচিত্রা (১৯৭৮)। অধিকাংশ বীরশ্রেষ্ঠের জীবন ও গৌরবের কাহিনী সেদিন ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে, সরকারি মহলেও এ নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। বীরশ্রেষ্ঠরা চলে আসেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। নানারকম অনুষ্ঠানের মাধ্যমে চলে বীরশ্রেষ্ঠ বন্দনা। হাতে আঁকা বীরশ্রেষ্ঠদের প্রতিকৃতি দিয়ে প্রকাশিত হয় ডাকটিকিট। সেই থেকে বীরশ্রেষ্ঠদের পরিবারের সদস্যরা আমন্ত্রিত হতে শুরু করেন বিভিন্ন জাতীয় অনুষ্ঠানে। একটি সংবাদপত্র যে কীভাবে জাতীয় ইতিহাসের উপাদানকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে পারে, বিচিত্রায় প্রকাশিত বীরশ্রেষ্ঠদের কাহিনী তার প্রমাণ।

বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান ১৯৫৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর থানার খোরদা খালিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আক্কাশ আলী একজন দরিদ্র কৃষক এবং মাতা কায়সুন্নেসা গৃহিণী ছিলেন।

 ইতিহাসের পাতায় স্থান পাওয়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার উৎপত্তিস্থল খুঁজলে সেখানে বৃহত্তর সিলেটের নাম পাওয়া যাবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই সিলেট বিভাগের মানুষ বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবীর এম.এ.জি ওসমানীও সিলেট বিভাগের মানুষ। সিলেটের কথা বারবার বলা হচ্ছে এই কারণে বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমানের চরম আত্মত্যাগের ঘটনা সিলেট বিভাগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সিলেট বিভাগের ধলই ফ্রন্ট। সেখানে এক সাধারণ সৈনিক সিপাহী হামিদুর রহমানের অসাধারণ কৃতিত্বের দরুণ গোটা যুদ্ধের গতি পরিবর্তিত হয়ে যায়। হামিদুর রহমান ১৯৭১ সালে অল্প সময়ের জন্য আনসার বাহিনীতে ছিলেন। ২ ফেব্রুয়ারি ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে ভর্তি হন। ভর্তির পর তিনি চট্টগ্রাম সেনানিবাস ইস্ট বেঙ্গল সেন্টারে প্রশিক্ষণের জন্য যান। ২৫ মার্চ প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলা সদর থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরবর্তী ধলই দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তের প্রায় ৪০০ গজ দূরে অবস্থিত ধলই চা বাগান। এরই পূর্বপ্রান্তে ধলই বর্ডার আউটপোস্ট অবস্থিত। ধলই সীমান্ত চৌকি থেকে নেমে মাত্র ২০০ গজ দূরে বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্ত খুঁটি। চা পাতার সবুজ বুক চিরে আঁকাবাঁকা টিলার পথ চলে গেছে সীমান্তে। খুঁটিগুলো ফসলের ক্ষেতে ক্ষীণ একটি ছড়ার জলরেখা দু’ভাগ করে দিয়েছে দুদেশের জনপদ।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই ধলই সীমান্ত ফাঁড়িটির গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে পাকিস্তানী বাহিনী ফাঁড়িটি তাদের দখলে নিয়ে যায়। যোগাযোগের ক্ষেত্রে অঞ্চলটি দুর্গম হলেও মৌলভীবাজার জেলার বিস্তৃত অঞ্চলের প্রবেশের ক্ষেত্রে এ সীমান্ত ফাঁড়িটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সীমান্ত রেখার দু’পাশ থেকেই দু’অঞ্চলে সহজে নজর রাখা যায়। দেশের অভ্যন্তরে সীমান্ত ফাঁড়িটির একদিকে রয়েছে শ্রীমঙ্গল থানার সীমান্ত এলাকা জুড়ে চা বাগান এবং সমতল মিলে সীমান্ত জনপদ।

সামরিক দিক থেকে এই ফাঁড়িটি দখল করা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তিযোদ্ধারা সীমান্তের ওপার ভারত থেকে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে প্রবেশ করতে এই ফাঁড়িতে অবস্থানরত পাক হানাদার বাহিনীর বাধার সম্মুখীন হয়। এই ঘাঁটি দখলের দায়িত্ব দেয়া হয় প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘সি’ কোম্পানিকে। ২৮ অক্টোবর ভোরে আক্রমণের দিনক্ষণ নির্ধারণ করা হয়। রাত ১০টায় যাত্রা শুরু হয়। ভোর চারটায় লক্ষ্যস্থলের কাছে পৌঁছতে চূড়ান্ত আক্রমণ করার কথা। গাছপালার জন্য রাতের অন্ধকার এমন জমাট বেঁধে ছিল যে মাত্র কয়েক হাত দূরে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। চরম প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও ‘সি’ কোম্পানির সৈন্যরা দুই প্লাটুন সামনে ও এক প্লাটুন অনুসরণকারী হয়ে অগ্রসর হতে থাকে। শত্রুর অবস্থান পর্যবেক্ষণের জন্য হাবিলদার মকবুল গাছে উঠেন। অন্ধকার কেটে যাওয়ার পর তিনি গাছ থেকে নামার পরপরই শুরু হয় শত্রুর গোলাবর্ষণ। গুলীর গতি পরিবর্তনের জন্য অধিনায়ক লে. কাইউম গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্যে শত্রুর ওপর পাল্টা গোলাবর্ষণের জন্য বেতারে যোগাযোগ করেন। গোলাবর্ষণের ফলে ঘাঁটির এক অংশে আগুন ধরে যায় এবং শত্রুর গোলাগুলী বন্ধ হয়ে যায়। ‘সি’ কোম্পানির সৈনিকরা এবার অগ্রসর হতে থাকে। কিšুÍ ঘাঁটির কাছাকাছি আসতেই মাইন ফিল্ডে বিস্ফোরণের ফলে বেশ কিছু সৈন্য হতাহত হয়। ঘাঁটির চতুর্দিকে মাইন পুঁতে তাকে সুরক্ষিত করা হয়েছিল। মাইন বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় শত্রুর অবিরাম গুলীবর্ষণ। আকস্মিক আক্রমণে হতাহতের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যায়। বাধ্য হয়ে সৈনিকরা ভূমিতে অবস্থান নেয়। আর অধিক অগ্রসর হওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। এদিকে ঘাঁটির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণায় শত্রুর এলএমজির অবস্থানের ফলে গাছপালার জন্য নিজস্ব মেশিনগান দিয়ে গুলী করেও কোন ফল হচ্ছিল না। এলএমজিটা বিধ্বস্ত করতে না পারলে ঘাঁটি দখল অসম্ভব। এই অসম্ভবকে সম্ভব করার জন্য এগিয়ে এলেন সিপাহী হামিদুর রহমান।

সাবধানে বুকে হেঁটে মুষলধারে বিক্ষিপ্ত গুলী-বৃষ্টি উপেক্ষা করে ক্রলিং করে শত্রুর অগোচরে তিনি এগিয়ে গেলেন এলএমজির পোস্টের কাছে। বুকের নিচে কঠিন মাটি, সামনে পেছনে, ডানে-বাঁয়ে-ওপরে চলছে গুলি। উভয়পক্ষের আগ্নেয়াস্ত্রের মুহুর্মুহু গর্জন শান্ত প্রকৃতিকে করে তুলেছিল বিভীষিকাময়। সবকিছু উপেক্ষা করে, এমনকি নিশ্চিত মৃত্যুকে অবহেলা করে হামিদুর রহমান ঝাঁপিয়ে পড়েন শত্রুর এলএমজি পোস্টের ওপর। এলএমজি চালনায় নিয়োজিত দুই শত্রু সেনার সঙ্গে শুরু হয় ধস্তাধস্তি। ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি এসে তাঁর সমস্ত শরীর ঝাঝরা করে দেয়। তিনিও ক্ষত-বিক্ষত করে দিলেন এলএমজির চালক দু’জনকে। এলএমজি বিধ্বস্ত হলো, তিনিও নিথর হলেন। এলএমজি নিষ্ক্রিয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সক্রিয় হয়ে উঠলেন মুক্তিযোদ্ধারা। ঘাঁটি দখল হলো, যুদ্ধের গতিও পরিবর্তন হয়ে গেল।

ধলই সীমান্ত অঞ্চলটি ছিল জেড ফোর্সের অধীনে। বারবার মুক্তিযোদ্ধারা চেষ্টা করেও এ সীমান্ত দিয়ে দেশে ঢুকতে পারছিলেন না পাকিস্তানী আর্মির প্রতিরোধের কারণ। ১২-১৩ দিন ধরেই ধলই সীমান্তে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর যুদ্ধ হচ্ছিল। ২৮ অক্টোবর রাত প্রায় ২টার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা ধলই সীমান্তে ক্যাপ্টেন নূর, ক্যাপ্টেন মাহবুব, ক্যাপ্টেন কাইয়ুম, ক্যাপ্টেন হাকিমের নেতৃত্বে অবস্থান নেন। ক্যাপ্টেন সাজ্জাদুর রহমান ছিলেন সে যুদ্ধে এফএফ বাহিনীর নেতৃত্বে। সিপাহী হামিদুর রহমান যে প্লাটুনের অধীন ছিলেন তার নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন কাইয়ূম। যুদ্ধ শুরু হয় আনুমানিক ভোর ৪টার দিকে। সেদিনকার যুদ্ধে সিপাহী হামিদুর রহমান শহীদ হন, আহত হন অন্তত ১৪-১৫ জন মুক্তিযোদ্ধা। তবে অনেক পাকিস্তানী সেনা নিহত হয়।

সেদিন হামিদুরের মৃতদেহটি সহযোদ্ধারা কাঁধে বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন সীমান্তের ওপারে। পরবর্তী সময়ে তাঁকে সীমান্ত থেকে দেড়-দু’মাইল অভ্যন্তরে ভারত এলাকার ‘আমবাসা’ গ্রামে সমাধিস্থ করা হয়।

কবর থেকে লাশ বা দেহাবশেষ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নেয়ার বিষয়টি নতুন ঘটনা নয়। বায়তুল মোকাররমের খতিব প্রয়াত উবায়দুল হকও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে একে বৈধ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। বাংলাদেশের ভেতরেও এর উদাহরণ আছে। প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের লাশ চট্টগ্রামের দুর্গম স্থানের কবর থেকে তুলে ঢাকায় আনা হয়েছিল।

ইতিহাসে লাশ বা দেহাবশেষ বহনের বড় উদাহরণ ফরাসি শাসক নেপোলিয়ন বোনাপার্ট-এর লাশ। ১৮১৫ সালে ওয়াটারলু যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে পরাজিত হয়ে তাকে নির্বাসনে যেতে হয় সেন্ট হেলেনা দ্বীপে। সেখানেই নিঃসঙ্গ অবস্থায় তার মৃত্যু হয় ৫ মে ১৮২১ সালে। এর প্রায় ঊনিশ বছর পর ১৮৪০ সালে তার লাশ ফ্রান্সে আনা হয় রাষ্ট্রীয় সম্মানে। বিশ্বখ্যাত সাহিত্যিক অস্কার ওয়াইল্ডের লাশও স্থানান্তরিত হয়। কোরিয়ান ওয়ারসহ বিভিন্ন যুদ্ধে নিহত আমেরিকান সৈন্যদের লাশ পাঠানোর ঘটনা নিয়মিতই ঘটছে। কয়েক হাজার বছর আগে মারা যাওয়া ইজিপশিয়ান ফারাওদের মমি সে দেশে ফিরিয়ে দেয়ার একটি দাবির কথাও সম্প্রতি শোনা যাচ্ছে।

কথিত আছে, আলেকজান্ডার দি গ্রেট বিশ্ব জয় করার শেষপ্রান্তে এসে তার সহযোগীদের বলেছিলেন, যদি আমি মারা যাই তবে লাশ নিয়ে ফেরার পথে আমার ডান হাত বাইরে বের করে রেখো। যেন মানুষ বুঝতে পারে বিশ্বজয়ী আলেকজান্ডার আজ ঘরে ফিরছে শূন্য হাতে। প্রচলিত এ বক্তব্যের সঙ্গে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুরের অনেক পার্থক্য ছিল।

স্বাধীনাতর ৩৭ বছর পর তিনি ঘরে ফিরেছেন। তবে শূন্য হাতে নয়, বাংলাদেশের মানুষের হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসায় পূর্ণ হয়েই তিনি দেশে ফিরে এসেছেন। এদেশের মানুষকে তার মতো বীরেরা জীবনের বিনিময়ে এনে দিয়েছেন সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ-স্বাধীনতা।

ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের দেহাবশেষ ভারত থেকে বাংলাদেশে আনার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এ লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মোঃ হুমায়ুন কবির খানকে দলনেতা করে ৭ সদস্যবিশিষ্ট প্রতিনিধি দল গঠন করা হয়। প্রতিনিধি দলের অন্য সদস্যরা হচ্ছেন- সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের বেসামরিক-সামরিক সংযোগ পরিদফতরের উইং কমান্ডার এম ইউসুফ আলী পিএসসি, কলকাতাস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রথম সচিব এটিএম মমিনুল হক, লে. কর্নেল কাজী সাজ্জাদ, এ জহির বীরপ্রতীক, সেন্টার পর বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার স্টাজিডের চেয়ারম্যান এবং চিফ রিসার্জার মেজর (অব.) কামরুল হাসান ভূঁইয়া, সাভার সেনানিবাসের ৯ পদাতিক ডিভিশনের প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের সার্জেন্ট মিরান হোসেন মোল্লা এবং হামিদুর রহমানের ভ্রাতা মোঃ ফজলুর রহমান। হামিদুর রহমানের রক্তের আল্পনায় আঁকা চিরসবুজ বাংলাদেশে তাঁর দেহাবশেষ আনতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যগ্মসচিব হুমায়ুন কবীর খানের নেতৃত্বে ৭ সদস্যের প্রতিনিধি দলের সদস্যরা লে. কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীরপ্রতীক, মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া, উইং কমান্ডার ইউসুফ আলী, হাবিলদার মেহরাজ ও বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের ছোট ভাই ফজলুর রহমান ৭ ডিসেম্বর ২০০৭ বিকাল ৩টা ৪৫ মিনিটে কুমিল্লার বিবিরবাজার স্থলবন্দর হয়ে ভারতের ত্রিপুরায় যান। এ প্রতিনিধি দলের অপর সদস্য কলকাতায় বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব মমিনুল হক তাদের সঙ্গে ত্রিপুরার আগরতলায় মিলিত হন।

৮ ডিসেম্বর সকালে আগরতলায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে বাংলাদেশ-ভারতের প্রতিনিধি দল নিয়ে গঠিত কো-অর্ডিনেশন কমিটি কবর খোঁড়ার সময় চূড়ান্ত করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব হুমায়ুন কবীর খান ও ত্রিপুরা রাজ্য সরকারের পলিটিক্যাল সেক্রেটারি ডিকে চক্রবর্তী ওই বৈঠকে নিজ নিজ দেশের পক্ষে সভাপতিত্ব করেন।

পরদিন ৯ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ৮টায় দুই দেশের প্রতিনিধি দল হামিদুর রহমানের সমাধিস্থল ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে ধলই জেলার আমপাশা থানার হাতিমারাছড়া গ্রামে পৌঁছে। ভারতীয় সময় সকাল ১০টায় কবর খোঁড়ার কাজ শুরু হয় শেষ হয় দুপুর ১২টায়। উত্তোলনের পরপরই হামিদুর রহমানের দেহাবশেষের প্রতি রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান জানাতে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য সরকার গার্ড অব অনার প্রদান করে। দুই দেশের উপস্থিত শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তারা ১ মিনিট নীরবতা পালন করে এ বীরশ্রেষ্ঠকে স্মরণ করেন। ভারতীয় পুলিশ প্রহরায় সেখান থেকে ভারতীয় বিএসএফের ডিআইজি এসএন সাজন, সোনামুড়া জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এ. কে. ভট্টাচার্য ও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে ভারতে যাওয়া প্রতিনিধি দল দেহাবশেষের কফিন নিয়ে ওইদিন ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা সার্কিট হাউসে রাতযাপন করে।

বীরশ্রেষ্ঠের কফিন বাংলাদেশে নিয়ে আসার আগে সকালে আগরতলা সার্কিট হাউসে ত্রিপুরা রাজ্য সরকারের মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারসহ ভারত সরকারের স্থানীয় প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিরা বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পরে ভারতীয় কর্মকর্তারা সড়কপথে মোটর শোভাযাত্রা সহকারে বেলা ২টা ১৩ মিনিটে সীমান্তের ২০৮৩ এর সাব পিলার নং এস-১১ এর কাছে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের শ্রীমন্তপুর ভূখ-ে হামিদুর রহমানের দেহাবশেষের কফিনটি বিশেষভাবে নির্মিত মঞ্চে এনে রাখা হয়। সেখানে ভারতের পক্ষে ত্রিপুরা এস্টেটের রাইফেলসের ১১তম ব্যাটালিয়ান (বিএলএফ) গার্ড অব অনার প্রদান করে। পরে সোনামুড়া নগর পঞ্চায়েতের চেয়ারপারসন শ্যামল চক্রবর্তী, বিএসএফের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড অশনী জাগদী, সোনামুড়া মহকুমার এসপিএম আনন্দ কুমার ভট্টাচার্য, সোনামুড়া মহকুমা পুলিশ কর্মকর্তা কমল চক্রবর্তী, শ্রীমন্তপুর বিএসএফ কমান্ডার ভুবন যোশিসহ সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা ফুলের তোড়া দিয়ে শেষবারের মতো শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ সময় ভারতের শ্রীমন্তপুর ও বাংলাদেশের কুমিল্লার বিবিরবাজার এলাকায় উপস্থিত জনতার পিনপতণ নীরবতা স্মরণ করিয়ে দেয় সেই ভয়াল মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি।

এখানে ভারতের বিএসএফ, পুলিশ-প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা হামিদুর রহমানের কফিনে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও গার্ড অব অনার প্রদানসহ শ্রদ্ধা নিবেদনের পর কফিন তুলে দেয়া হয় বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বিডিআরের হাতে। বিডিআরের পক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে কফিন গ্রহণ করেন ৩৩ রাইফেলস ব্যাটালিয়নের কমান্ডার লে. কর্নেল আব্দুল মুকিম সরকার ও লে. কর্নেল নূরে আলম। প্রথমে বিডিআরের (কুড়িগ্রাম-ঠ-১১০০০৫) গাড়িতে হামিদুর রহমানের কফিনটি তুলে সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে আস্তে আস্তে নিয়ে আসা হয় বাংলাদেশের কুমিল্লার বিবিরবাজার স্থলবন্দর নবনির্মিত চত্বরে। এখানে বিডিআর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে হামিদুর রহমানের কফিন গ্রহণ করেন সেনাবাহিনীর ৩৩ পদাতিক ডিভিশনের এরিয়া কমান্ডার (জিওসি) মেজর জেনারেল আব্দুল হাফিজ পিএসসি। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আনিছুর রহমান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুজিবুর রহমান, কর্নেল সাব্বিরসহ সেনা কর্মকর্তারা। সেনাবাহিনীর একটি সুসজ্জিত দল হামিদুর রহমানের দেহাবশেষের কফিন বিডিআরের গাড়ি থেকে নামিয়ে কাঁধে করে বিবিরবাজার স্থলবন্দরে নির্মিত সুসজ্জিত মঞ্চে নিয়ে আসে। হামিদুর রহমানের কফিনটি যখন দেশের মাটি স্পর্শ করে তখন বিকাল ৩টা ৭ মিনিট।

বিবিরবাজার স্থলবন্দরের ওই মঞ্চে মেজর পারভেজের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর একটি চৌকস দল হামিদুর রহমানকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। এ সময় বিউগলে করুন সুর বেজে ওঠে। পরে মেজর জেনারেল আব্দুল হাফিজ পিএসসি কফিনে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। হামিদুরের সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তান্ত পাঠ করে শোনান লে. কর্নেল সফিউল হক চৌধুরী। পরে একে একে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব আবুল কাশেম মোঃ মাহবুবুল আলম বীরপ্রতীক, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার হোসেন জামিল, জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড ও তার সহযোগী যোদ্ধাদের পক্ষে আলহাজ্ব নূরে আলম ভূঁইয়া, বাহাউদ্দিন রেজা বীরপ্রতীক, সহিদউদ্দিন ভূঁইয়া পাটোয়ারী, জেলা প্রশাসক মোঃ মনজুরুর রহমান, পুলিশ সুপার মীর শহীদুল ইসলাম পিপিএম, সদর উপজেলা ইউএনও এ.কে.এম. সোহেল, সুশীল সমাজের পক্ষে অধ্যক্ষ আমির আলী চৌধুরী, মুক্তিযোদ্ধা সমবায় সমিতি লিঃ এর চেয়ারম্যান শহিদুল হক সেলিম ও ডাঃ যোবায়দা হান্নান। তাছাড়া উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধা, বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দও এ সময় ফুলের তোড়া দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ সময় জেলার বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও হাজার হাজার আবালবৃদ্ধবণিতা উপস্থিত থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

স্থলবন্দরে সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে সেনাবাহিনীর একটি সুসজ্জিত (টি-০৫৯১০১) গাড়িতে করে হামিদুর রহমানের কফিনের শোভাযাত্রা বিকাল ৩টা ৩৫ মিনিটে বিবিরবাজার-কুমিল্লা সড়ক হয়ে কুমিল্লা সেনানিবাসের উদ্দেশে যাত্রা করে। এ সময় বিবিরবাজার থেকে কুমিল্লা শহর হয়ে সেনানিবাস পর্যন্ত সড়কের বিবিরবাজার, ঝাঁকুনিপাড়া, রাজমঙ্গলপুর, বাজগড্ডা, অরণ্যপুর, জগন্নাথপুর, সংরাইশ, তেলিকোনা, শহরের চকবাজার, রাজগঞ্জ, মোগলটুলি, সার্কিট হাউস রোড, ডিসি রোড, পুলিশ লাইন, রেসকোর্স, শাসনগাছা, দুর্গাপুর, আলেখারচরসহ বিভিন্ন এলাকায় মাইলের পর মাইল রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধা, বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, সুশীল সমাজসহ সমাজের নানান শ্রেণী-পেশার হাজার হাজার জনতা হাতে জাতীয় পতাকা, ব্যানার ও ফেস্টুন বহন করে হামিদুর রহমানের কফিনে ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে এ বীর সন্তানকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

১১ ডিসেম্বর কুয়াশাসিক্ত ভোরের সূর্য তখনও আকাশ ফুটে ওঠেনি। ৬টা ১০ মিনিটে কুমিল্লা ৩৩ পদাতিক ডিভিশনের পক্ষ থেকে কুমিল্লা সেনানিবাসে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর সুসজ্জিত কফিনটি মিলিটারি পুলিশের বহরে রওনা করে ঢাকার উদ্দেশ্যে। ৮টা ৫ মিনিটে ঢাকার যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তায় পৌঁছে। সেখানে পুলিশের একটি মোটরসাইকেল বহর যোগ হয়। যাত্রাবাড়ী থেকে কফিনটি নেয়া হয় বঙ্গভবনের সামনে। বঙ্গভবনে আগে থেকেই ঢাকা সেনানিবাসের একটি টিম প্রস্তুত ছিল। কুমিল্লা থেকে আসা টিম ঢাকা সেনানিবাসের টিমের কাছে কফিন হস্তান্তর করে ফিরে যায়। ঢাকা সেনানিবাসের টিমের মোটরসাইকেল, পিকআপ ভ্যান, খোলা জিপ সমন্বয়ে মোটর শোভাযাত্রার মাধ্যমে ফুলে ফুলে ঢাকা কফিনটি ৮টা ৩৫ মিনিটে বঙ্গভবন থেকে রওনা করে। বহরটি কাকরাইল, শেরাটন হয়ে ভিআইপি রোড ধরে চলে যায় ঢাকা সেনানিবাসের এভিয়েশন হ্যাংগারে। এ পথ পাড়ি দিতে যতগুলো জেলা ও থানা অতিক্রম করতে হয়েছে সংশ্লিষ্ট থানা ও জেলা পুলিশ বীরশ্রেষ্ঠের কফিন বহনকারী মোটরযাত্রাকে স্কট দিয়েছে। এভিয়েশন হ্যাংগারে রেখে কফিনটিকে জাতীয় প্যারেড স্কোয়ারে নেয়ার যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়। প্যারেড স্কোয়ারে হাজারও মানুষ। শ্রদ্ধা আর আকাঙ্খা নিয়ে অপেক্ষা করছিল সবাই। এরই মাঝে আকাশ কাঁপানো ‘তোপধ্বনি’ বদলে যায় পুরো আবহ। ১০টা ৩২ মিনিটে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুরের দেহাবশেষ নিয়ে মোটর শোভাযাত্রা প্রবেশ করে জাতীয় প্যারেড স্কোয়ারে।

হামিদুর রহমানের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য সকালে জাতীয় প্যারেড স্কোয়ারে আয়োজন করা হয় বিশেষ অনুষ্ঠানের। মুক্তিযুদ্ধের অমিত সাহসী বীর হামিদুর রহমানের দেহাবশেষ নিয়ে মোটর শোভাযাত্রা জাতীয় প্যারেড স্কোয়ার সীমানায় প্রবেশ করে সকাল ১০টা ৩২ মিনিটে। এ সময় ২১ বার তোপধ্বনি করা হয়। এর আগে প্যারেড স্কোয়ারে প্রবেশ করেন রাষ্ট্রপতি, প্রধান উপদেষ্টা, জাতীয় সংসদের স্পীকার, তিন বাহিনীর প্রধান, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারগণ, বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের পরিবারের সদস্যরা।

ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) এম.এ. মতিন, স্থানীয় সরকার বিষয়ক উপদেষ্টা আনোয়ারুল ইকবাল, ধর্মবিষয়ক উপদেষ্টা ডা. এ.এস.এম.মতিউর রহমান, জ্বালানি উপদেষ্টা তপন চৌধুরী, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মইন উ. আহমেদ, নৌ বাহিনী প্রধান ভাইস এডমিরাল সরওয়ার জাহাজ নিজাম, বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এসএম জিয়াউর রহমান, সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, মুক্তিযুদ্ধের উপ-অধিনায়ক এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ.কে. খন্দকার, এস ফোর্স প্রধান মেজর জেনারেল (অব.) কে.এম. সফিউল্লাহ, সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব.) সি.আর. দত্ত, আওয়ামী লীগ সভাপতিম-লীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাক, প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লে. জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, সাবেক সেনাপ্রধান লে. জেনারেল মাহবুবুর রহমান, লে. জেনারেল হারুনুর রশিদ, বিএনপি নেতা মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকা প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

লাল-সবুজ রঙে খচিত বাংলাদেশের জাতীয় পতাকায় আচ্ছাদিত বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহি হামিদুর রহমানের কফিন যখন প্যারেড গ্রাউন্ডে প্রবেশ করে, তখন চারদিকে বিরাজ করছিল এক ভাবগম্ভীর পরিবেশ। শেষ হেমন্তের রোদ ঝলমলে সকালে হামিদুরকে বরণ করতে পুরো বাংলাদেশ যেন উঠে এসেছিল একাত্তর হয়ে। ফুলে ফুলে সাজানো সেনাবাহিনীর একটি খোলা জিপে করে বয়ে আনা হয় হামিদুরের কফিন। বীরশ্রেষ্ঠকে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য নির্মিত মঞ্চের দক্ষিণ দিকে একটু দূরে কফিনটি গাড়ি থেকে নামিয়ে ৪ জন সেনাসদস্য তা বহন করে নিয়ে আসেন মঞ্চে। সেখানে রাখার পর  প্রথমে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন রাষ্ট্রপতি। এরপর প্রধান উপদেষ্টা। ১০টা ৪২ মিনিটে দেশ মাতৃকার এই বীর সন্তানের প্রতি সশস্ত্র সম্মান প্রদর্শন করে তিন বাহিনীর একটি চৌকস দল। এ সময় বিউগলে বেজে ওঠে করুন সুর। এরপর অনুষ্ঠানে সিপাহী হামিদুর রহমানের (আর্মি নম্বর ৩৯৪) জীবনের সারাংশ পাঠ করা হয়। হামিদুর রহমানের আত্মার শান্তি এবং দেশের কল্যাণ কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়।

রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ বীরশ্রেষ্ঠের পতাকা মোড়ানো কফিনে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন এবং জাতির পক্ষ থেকে তিনি হামিদুর রহমানের দেহাবশেষ গ্রহণ করেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমদ, ৪ জন উপদেষ্টা, তিন বাহিনীর প্রধানগণ, সেক্টর কমান্ডার ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা কফিনে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। জাতীয় সংসদের স্পীকার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধা এবং হামিদুর রহমানের পরিবারের সদস্যরা হামিদুরের কফিনে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ডেপুটি হাই কমিশনার মুক্তাদত্ত তমার নেতৃত্বে ঢাকায় ভারতীয় হাই কমিশন কফিনে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। এরপর সর্বস্তরের মুক্তিযোদ্ধা এবং সাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য ২০ মিনিট সেখানে কফিনটি রাখা হয়। হামিদুরের তিন ভাই, দুই বোনসহ পরিবারের অন্যরা কফিনে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন। সাবেক রাষ্ট্রপতি, রাজনীতিবিদ, সাবেক পদস্থ সামরিক কর্মকর্তা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, কূটনীতিকসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ উপস্থিত হন একাত্তরের বীর সন্তানকে শেষ বিদায় জানাতে। এ সময় এক আবেগঘন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় পুরো প্রাঙ্গণ জুড়ে।

জাতীয় প্যারেড স্কোয়ারে রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষে মোটর শোভাযাত্রা করে বীরশ্রেষ্ঠের লাশ নিয়ে যাওয়া হয় মিরপুরের বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে। সেনাবাহিনীর চৌকস দলের গার্ড অব অনার, গান স্যালুটের মাধ্যমে তাঁকে সমাহিত করা হয়। এরপর মরণোত্তর সম্মান প্রদর্শন করা হয়।

হামিদুরের ছোট ভাই শুক্কুর আলী বলেন, আজ আমাদের জন্য একটা খুশির দিন। কিন্তু দুঃখ হচ্ছে আমাদের মা এ দিনটি দেখে যেতে পারলেন না। তার বড় ইচ্ছা ছিল তিনি ছেলের কবর দেখে মরবেন। সে আশা পূরণ হয়নি। তারপরও এ সরকারের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। তাদের ধন্যবাদ জানাই দেশের এই বীর সন্তানকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য। হামিদুর রহমানের বোন আছিয়া খাতুন ভাইয়ের স্মৃতিচিহ্ন হাতের নাগালে পেয়ে আনন্দাশ্রু ধরে রাখতে পারছিলেন না। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, আমাদের ভাই যুদ্ধে শহীদ হলেন-এ খবর আমার মা পেয়েছেন দেশ স্বাধীন হওয়ার পর। তারপর মা প্রতিদিন অপেক্ষা করতেন ছেলের লাশ ফিরে পাওয়ার জন্য। আমরাও ভাইয়ের লাশ দেখার জন্য অপেক্ষা করেছি, কেঁদেছি। মা-বাবা অনেক কষ্টে আমাদের বড় করেছেন। আমাদের ভাই বেঁচে থাকলে এমন কষ্ট হয়তো হতো না। আমাদের ভাইকে আজ এত বড় সম্মান দেয়া হল, এটা মা দেখে যেতে পারলে খুশি হতেন।’ (সূত্রঃ দৈনিক যুগান্তর ১১ ডিসেম্বর ২০০৭)

বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমানের ছোট ভাই ফজলুর রহমান বলেন, আজকের দিনটি শুধু আমাদের পরিবারের জন্য নয়, গোটা বাংলাদেশের জন্যই গর্বের দিন, স্মরণীয় দিন। এ দিনটির জন্য আমাদের পরিবার দীর্ঘ ৩৬ বছর অপেক্ষার প্রহর গুণেছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সরকারের কাছে এ ব্যাপারে আমরা বারবার আবেদন করেও সাড়া পাইনি। তিনি বলেন, আজকের এই খুশির দিনটিতে যিনি সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন তিনি আমার মা। তিনি ২০০৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মারা গেছেন। অথচ ছেলের দেহাবশেষ আসার অপেক্ষায় আমার মা অনেক কেঁদেছেন। তার মৃত্যুর পর হামিদুরের দেহাবশেষ দেশে এসেছে। আমার মায়ের শেষ ইচ্ছা পূরণ হলেও তিনি তা দেখে যেতে পারেননি। তারপরও আমরা খুশি। যে জাতির স্বাধীনতার জন্য আমার ভাই যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন সেই স্বাধীন স্বদেশ ভূমিতে দীর্ঘ ৩৬ বছর পর তার সমাধি হতে যাচ্ছেÑ তা খুবই আনন্দের ও গৌরবের। (সূত্রঃ দৈনিক যায়যায়দিন ১১ ডিসেম্বর ২০০৭)

হামিদুর রহমানের পরিবারের সম্বল মাত্র পাঁচ বিঘা চাষযোগ্য জমি আর নি¤œপদের একটি সরকারি চাকরি। বড় ভাই হামজুর রহমান সরকারের মৎস্য বিভাগে গার্ডের চাকরি করেন। অন্য দু’ভাই শুকুর আলী ও ফজলুর রহমানের আয়ের সুনির্দিষ্ট কোন উৎস নেই। পারিতোষিক হিসেবে প্রাপ্য ১৪ হাজার টাকা ভাগাভাগি করে নেন তিন ভাই।

১৯৮১ সালে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সরকার তাদের বসতবাড়ি তৈরি করে দেয়। ঠিকাদার বাড়িটির নির্মাণকাজে ব্যাপক অনিয়ম করে। ফলে অল্পদিনেই বাড়িটি বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ে।

রাজধানীতে প্লট দিল না কোনো সরকার। বীরশ্রেষ্ঠের গ্রামটি নামেই হামিদনগর, খাতাকলমে এখনও খোর্দখালিশপুর। গ্রামটির রাস্তাঘাটের জীর্ণদশা। বহু তদবির সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এদিকে নজর দেয়নি। অথচ বীরশ্রেষ্ঠের গ্রাম হওয়ায় বহু ভিআইপিদের আগমন ঘটে গ্রামটিতে।

যে মাটির টানে স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সিপাহী হামিদুর রহমান, সেই মুক্ত মাটিতে তাঁর মরদেহ নিয়ে আসতে যেমন করা হয়েছে নানা দীর্ঘসূত্রতা তেমনি দেশের পাঠ্যপুস্তকে তাঁর রক্তে ভেজা রণাঙ্গনের সঠিক তথ্য উল্লেখ করা হয়নি।

বর্তমানে ধলই সীমান্ত ফাঁড়ির কাঁঠালতলার সম্


মন্তব্য লিখতে লগইন অথবা রেজিস্ট্রেশন কর