None

26 October, 2017


গাইবান্ধা জেলার পরিচিতি : বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ব্রহ্মপুত্র নদের পশ্চিম তীরে গাইবান্ধা জেলা অবস্থিত। গাইবান্ধার উত্তরে কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলা, পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদ প্রবাহিত, দক্ষিণে বগুড়া জেলার সোনাতোলা শিবগঞ্জ উপজেলা, উত্তর-পশ্চিমে রংপুরের পীরগাছা, মিঠাপুকুর ও পীরগঞ্জ উপজেলা, পশ্চিমে দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট উপজেলা এবং জয়পুরহাট জেলার কালাই উপজেলা অবস্থিত। আশিরদশকে মহকুমাগুলোকে জেলা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হলে ১৯৮৪ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি গাইবান্ধা মহকুমা থেকে জেলায় রূপান্তরিত হয়। বৃহত্তর রংপুর জেলা অন্তর্গত গাইবান্ধা মহকুমার সৃষ্টি হয়েছিল ১৮৫৮ সালের ২৭ আগস্ট। তখন এর নাম ছিল ভবানীগঞ্জ। মহকুমা সদর দফতর ছিল বর্তমান গাইবান্ধা শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার পূর্বে ভবানীগঞ্জে। ১৮৭২ সালের প্রথমদিক থেকে ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্বপাড়া জুড়ে ভবানীগঞ্জ মহকুমা এলাকায় ব্যাপক নদী ভাঙ্গন শুরু হয়। অন্যদিকে রেললাইন প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হলে যোগাযোগের সুবিধার্থে রেল লাইনের কাছাকাছি ভবানীগঞ্জ মহকুমা শহর স্থানান্তরের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়। নদের ভাঙ্গন মারাত্মক আকার ধারণ করায় ১৮৭৫ সালের শেষ দিকে পাতিলাদহ পরগনার ভবানীগঞ্জ মৌজা থেকে ১২ কিলোমিটার পশ্চিমে রাজা বিরাটের কথিত গো-শালা ও গো-চারণভূমি হিসাবে পরিচিত গাইবান্ধা নামকস্থানে মহকুমা সদর স্থানান্তর করা হয়। সেই সাথে নাম পরিবর্তিত হয়ে এলাকার নাম অনুযায়ী মহকুমার নাম গাইবান্ধা করা হয়। ওই সময় মহকুমা প্রশাসক ছিলেন দেলওয়ার হোসেন। নতুন নামে, নতুন স্থানে গাইবান্ধা মহকুমার গোড়াপত্তন হবার পর শহরাঞ্চল গড়ে উঠতে শুরু করে। বৌদ্ধ, হিন্দু, মোঘল, পাঠান আমলসহ ইংরেজ শাসনামলের স্মৃতি বিজড়িত আমাদের এই গাইবান্ধা জেলা। বিভিন্ন শাসনামলে নানা সংগ্রাম-বিদ্রোহ এ অঞ্চলে সংঘটিত হয়েছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ততথ্যে এ ব্যাপারে বেশ কিছু ধারণা দেয়। গাইবান্ধা জেলার মূল ভূখণ্ড নদীর তলদেশে ছিল এবং কালক্রমে যা নদীবাহিত পলিতে ভরাট হয় এবং এ অঞ্চলে সংঘটিত একটি শক্তিশালী ভূমিকম্পের ফলে নদী তলদেশের উত্থান ঘটে এবং স্থলভূমিতে পরিণত হয়। তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীবাহিত পলি মাটি দিয়েই গড়ে উঠেছে আজকের গাইবান্ধা। জানা যায়, ইংরেজ গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেষ্টিংস তার শাসনামলে রংপুর জেলা কালেক্টরেটের আওতায় ১৭৯৩ সালে ২৪টি থানা প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমান গাইবান্ধা এলাকায় সে সময় ৩টি থানা প্রতিষ্ঠিত হয়। ২৭৮ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে গোবিন্দগঞ্জ থানা এবং ১৮৮ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে সাদুল্লাপুর থানা গঠিত হয়। দু’টি থানাই প্রতিষ্ঠিত হয় ইদ্রাকপুর পরগনায়। অপর থানাটি প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে পাতিলাদহ পরগনায় ৯৩ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে, ভবানীগঞ্জ মৌজায় ভবানীগঞ্জ থানা নামে। রংপুরের কালেক্টর ই-জি গেজিয়ার এর ১৮৭৩ সালের রিপোর্টে এই তথ্য উল্লেখিত হয়েছে। উক্ত রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে যে, রংপুর জেলার সদর থেকে সাদুল্লাপুর থানার দূরত্ব ছিল ৩৮ মাইল, গোবিন্দগঞ্জ ৫৬ মাইল এবং ভবানীগঞ্জের দূরত্ব ছিল ৫৪ মাইল। পরবর্তীতে ইংরেজ শাসনামলে এতদঞ্চলে সংঘটিত সন্ন্যাস বিদ্রোহ, ফকির মজনু শাহ, দেবী চৌধুরানী, ভবানী পাঠকসহ নানা বিদ্রোহীরা তাদের তত্পরতা চালাতেন মূলত ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা নদীপথে। তদুপরি গাইবান্ধার পার্শ্ববর্তী তুলসীঘাটের সাথে সিপাহী বিদ্রোহের কিছুটা সংযোগ ছিল বলে তথ্য পাওয়া যায়। রতনলাল চক্রবর্তী রচিত ‘বাংলাদেশে সিপাহী বিদ্রোহ’ গ্রন্থে লেখা হয়েছে যে, ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় একদল বিদ্রোহী সিপাহী রংপুরের দিকে এগিয়ে আসছে খবর পেয়ে রংপুর ট্রেজারির সম্পদ রক্ষার্থে তত্কালীন কালেক্টর ম্যাকডোনাল্ড ট্রেজারির সমুদয় মালামাল ঘোড়ার বহরে করে ৪০ মাইল দূরে তুলসীঘাটের গভীর জঙ্গলে লুকিয়ে রাখেন। তখন তুলসীঘাট নামক স্থানটি ঘন তুলসী গাছসহ বিভিন্ন গাছ-গাছালিতে পরিপূর্ণ ঘন জঙ্গল ছিল। আর তুলসী গাছের আধিক্যের কারণেই স্থানটির নাম হয়েছিল তুলসীঘাট। জেলা শহরের বর্তমান অবস্থানের গাইবান্ধা নামকরণ ঠিক কবে নাগাদ হয়েছে তার সঠিক তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি। কবে গাইবান্ধার নামকরণ সম্পর্কে দু’টি কিংবদন্তী প্রচলিত আছে। মহাভারতের বর্ণনা অনুসারে, পাঁচ হাজার বছর আগে মত্স্য দেশের রাজা বিরাটের রাজধানী ছিল গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ থানার রাজাহার ইউনিয়নের রাজা বিরাট এলাকায়। কিংবদন্তী বলা হয়ে থাকে এই বিরাট রাজার গো-ধনের কোন তুলনা ছিল না। তার গাভীর সংখ্যা ছিল ষাট হাজার। মাঝে মাঝে ডাকাতরা এসে বিরাট রাজার গাভী লুণ্ঠন করে নিয়ে যেতো। সেজন্য বিরাট রাজা একটি বিশাল পতিত প্রান্তরে গো-শালা স্থাপন করেন। গো-শালাটি ছিল সুরক্ষিত এবং গাভীর খাদ্য ও পানির সংস্থান নিশ্চিত করতে তা নদী তীরবর্তী ঘেসো জমিতে স্থাপন করা হয়। সেই নির্দিষ্ট স্থানে গাভীগুলোকে বেঁধে রাখা হতো। প্রচলিত কিংবদন্তী অনুসারে এই গাভী বেঁধে রাখার স্থান থেকে এতদঞ্চলের কথ্য ভাষা অনুসারে এলাকার নাম হয়েছে গাইবাঁধা এবং কালক্রমে তা গাইবান্ধা নামে পরিচিতি লাভ করে।


মন্তব্য লিখতে লগইন অথবা রেজিস্ট্রেশন কর