ছেলে ও মেয়ের মধ্যে বৈষম্যমূলক আচরণ
আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে, সমাজ-সভ্যতার শুরুতে নারী ও পুরুষে কোনো ভেদাভেদ বা বৈষম্য ছিল না। পরবর্তীকালে নানা কারণে নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য বা অসমতা সৃষ্টি হয়েছে। এ বৈষম্যের ভার নারীদের ই বেশি বহন করতে হয়।
মেয়ে শিশুদের প্রতি অযত্ন আর অবহেলা প্রায়ই লক্ষ্য করা যায়। শিক্ষা, পুষ্টি, চিকিৎসা সব ক্ষেত্রেই অবহেলার শিকার হয় মেয়েরা। ফলে সমান সম্ভাবনা থাকার পরও একটি মেয়ে একটি ছেলের মত একইভাবে দক্ষ হয়ে বেড়ে উঠতে না পেরে পদে পদে সে পিছিয়ে পড়ে। অথচ যথাযথ সুযোগ পেলে উভয়ই উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। আমাদের সমাজে সাধারণত মেয়ে আর ছেলের মথ্যে যে ধরণের বৈষম্য দেখা যায় সেগুলো হলো:
পুষ্টি: বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর-কিশোরীদের শরীর দ্রুত বাড়ে তাই এ সময়ে উভয়েরই প্রচুর আমিষ ও ভিটামিনযুক্ত খাবার প্রয়োজন। তবে আমাদের পরিবারগুলোতে প্রায়ই দেখা যায়, তারা ছেলেকে বেশি খাবার দেয় কিন্তু মেয়ের পর্যাপ্ত খাবারের ব্যাপারে উদাসীন থাকে, ফলে মেয়েটি অপুষ্টিতে ভুগতে থাকে। শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে বেড়ে ওঠে।
শিক্ষা: পরিবারে একটি মেয়ে যখন বড় হয়ে ওঠে তখন ধরে নেয়া হয় সে বিয়ের জন্য উপযুক্ত হয়েছে, সুতরাং তার আর লেখাপড়ার দরকার নেই। এছাড়াও রাস্তা ঘাটে মেয়েদের নিরাপত্তার অভাবে অনেক সময় স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়া হয়। সংসারে আর্থিক অনটন থাকলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মেয়েদেরই স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয় আগে। ফলে জীবন গঠনে বা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে একটি মেয়ে ছেলেদের চাইতে বরাবরই পিছিয়ে থাকে।
স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা: স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রেও মেয়েরা অবহেলার শিকার হয়ে থাকে। দেখা যায় একটি ছেলে অসুস্থ হলে তাকে ডাক্তার দেখানো হচ্ছে কিন্তু মেয়েকে সহজে ডাক্তারের কাছে নেয়া হচ্ছে না। এমনকি গর্ভাবস্থায়ও তার সঠিক যত্ন নেয়ার ক্ষেত্রে অবহেলা করা হয়।। এর কুফল একটি মেয়ে সারাজীবন ভোগ করে।
মর্যাদাবোধ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ: অনেক সময় ছোটবেলা থেকেই একটি মেয়েকে পরিবারে খাটো করে দেখা হয়, ভাল কাজের স্বীকৃতি দেয়া হয়না এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও তাকে অবহেলা করা হয়। এভাবে মর্যাদাহীনভাবে বেড়ে উঠতে উঠতে মেয়েরা মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং কখনো কখনো নিজের মর্যাদা বা অধিকারও বুঝতে পারে না।
মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা: ছোট-বড় কোনো ধরনের কাজেই মেয়েদের মতামতের কোনো মূল্য অনেক পরিবারের সদস্যরা দেয়না। যেমন-মেয়ের অমতে বিয়ে দেয়া, লেখাপড়া বন্ধ করে দেয়া, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে মিশতে না দেয়া, খেলাধুলা করতে না দেয়া, অল্প বয়সে বিয়ে দেয়া ইত্যাদি।
সম্পদ বণ্টন বা নিয়ন্ত্রণ: বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরিবারে মেয়েরা তার উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। দেখা যায় পরিবারের অন্যান্য মহিলা সদস্যরাও নিজেদের অধিকার সম্পর্কে অসচেতনতার কারণে ধরে নেন সম্পত্তিতে শুধুমাত্র ছেলেদেরই অধিকার রয়েছে। ফলে ধীরে ধীরে পারিবারিক ও সামাজিক চাপে মেয়েদের এটা মেনে নিতে হয়।
কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য: কাজের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ উভয়েরই সমান অধিকার রয়েছে কিন্তু আমাদের দেশে এই অধিকার প্রতি মুহূর্তেই লঙ্ঘিত হচ্ছে। দেখা যায় একটি ছেলে আর একটি মেয়ে একই কাজ করছে কিন্তু তাদেরকে পারিশ্রমিক একই রকম দেয়া হচ্ছে না। মেয়েরা যখন গর্ভবতী হচ্ছে তখন তাকে তার প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা দেয়া হচ্ছে না। এমন কি কখনো কখনো মেয়েটি চাকরি হারাচ্ছে। মনে রাখতে হবে কর্মসংস্থান সকল মানুষের মৌলিক অধিকার।
প্রজনন অধিকার: প্রত্যেক নারী-পুরুষেরই প্রজনন অধিকার যেমন-উপযুক্ত বয়সে বিয়ের অধিকার, সে কখন, কয়টি সন্তান নিতে চান সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার এবং তথ্য ও সেবা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। অথচ আমাদের দেশের মেয়েরা প্রায়ই এই তথ্য ও সেবা পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।