ছেলেমেয়ে কি আলাদা ভাবে বড় হবে

ছেলেমেয়ে বড় হোক একই নিয়মে
আহমেদ হেলাল, সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।
‘আস্তে কথা বলো, মেয়েদের এত জোরে কথা বলতে হয় না’—এক বাবা বলছেন তাঁর ১০ বছর বয়সী মেয়েকে। আবার মা হয়তো তাঁর ছোট্ট মেয়েকে শেখাচ্ছেন—কীভাবে শব্দ না করে হাসতে হবে, কীভাবে চেয়ারে বসতে হবে ইত্যাদি।
কেবল বাড়িতে নয়, স্কুলেও একই ধরনের ঘটনা দেখা যায়—ছেলেদের জন্য শিক্ষক এক নিয়ম করছেন আর মেয়েদের জন্য আরেক নিয়ম। ছোটবেলা থেকেই পরিবারে এবং পরিবারের বাইরে সবখানেই মেয়েদের জন্যই নিয়মের বেড়াজাল একটু বেশি। ‘সব কথা উচ্চারণ করতে হয় না’, ‘মেয়েদের এত রাগ করতে হয় না’, ‘এটা শিখতে হবে’, ‘ওটা শিখতে হবে’, ‘এই এই করা যাবে না’, ‘তুমি মেয়ে, সবকিছু তোমার জন্য নয়’—শুনতে শুনতে একজন কন্যাশিশু বেড়ে ওঠে।
কিন্তু ছেলেদের জন্য নিয়ম যেন ততটা নয়—সে অট্টহাসি হাসতে পারে, টিভিতে খেলা দেখে চিৎকার করতে পারে, বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতেও যেতে পারে। স্কুলে তারা মেয়েদের চাইতে কোনো কোনো বিষয়ে বেশি দায়িত্ব পায়। ছেলেরা কেবল শুনতে পায় ‘ছেলেদের কাঁদতে নেই’। কান্নাকে তারা পরাজয় মনে করে—কান্না চেপে রাখতে রাখতে ছেলেরা বড় হয়।
ঘরে-বাইরে সব জায়গায় ছেলেশিশু আর মেয়েশিশুর জন্য শেখানো নিয়মগুলো আলাদা হয়ে যায়। এতে করে তাদের মানসিকতার বিকাশ কিন্তু ভিন্নতর হতে থাকে। মেয়েদের মধ্যে সব সময় অবদমিত বোধ কাজ করে—আর ছেলেরা উচ্চক্ষমতায়িত বোধ করে। মেয়েদের ব্যক্তিত্ব তাই পরিণত বয়সে ‘বিষণ্নতাপ্রবণ’ হয়ে যায় আর ছেলেদের ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠে ‘বহির্মুখী’, কখনো ‘আগ্রাসী’। এই নিয়মের বেড়াজালে বড় হতে হতে মেয়েশিশুদের মধ্যে ‘লার্নড হেল্পলেস’-এর জন্ম নিতে পারে। এসব কারণে কখনো কখনো মেয়ে এবং ছেলেশিশু উভয়েই ভঙ্গুর ব্যক্তিত্ব নিয়ে বেড়ে ওঠে। সাদা চোখে আমরা দেখি, যারা খুব ভালো পার্থিব সাফল্য অর্জন করতে পেরেছে, তাদের মধ্যেও এ ধরনের ভঙ্গুর ব্যক্তিত্ব থাকতে পারে।
মেয়ের ক্ষেত্রে কী হয়
যখন একজন মেয়েশিশু আলাদা কিছু নিয়ম আর উপদেশ পেতে থাকে আর সে দেখে তার বয়সী একটি ছেলের জন্য সেই নিয়ম আর উপদেশ নেই, তখন এই বৈষম্যমূলক ‘নিয়ম মানার নির্দেশ’-এ তার মনোজগৎ নানাভাবে পরিবর্তিত হতে থাকে—
নিজেকে ছোট মনে করে, আত্মবিশ্বাস কমে যায়
ছেলেদের শক্তিশালী মনে করে
নিজের মতামত প্রকাশ করতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়
আবেগের বহিঃপ্রকাশ বা আবেগ নিয়ন্ত্রণ বাধাগ্রস্ত হয়
পরিবার ও সমাজ থেকে নিজেকে খানিকটা বিচ্ছিন্নবোধ করে
ছোট ছোট দৈনন্দিন সমস্যা সমাধানের কৌশল রপ্ত করতে পারে না
কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে পারে না
সামাজিক দক্ষতা কমে যেতে থাকে
নিজের মধ্যে খানিকটা হতাশা তৈরি হতে পারে, হতে পারে বিষণ্নতা
ব্যক্তিত্বের সমস্যা আর নিজের হাত-পা কাটাসহ নানা ক্ষতি করার প্রবণতা দেখা দিতে পারে
ছোটবেলার শিক্ষণ-প্রক্রিয়ার কারণে পরিণত বয়সে তার পারিবারিক ও পেশাগত জীবন সংকটে পড়তে পারে
ছেলের ক্ষেত্রে কী হয়
নিজেকে মেয়েদের চাইতে আলাদা মনে করে, একটু বেশি শক্তিশালী মনে করে
মেয়েদের প্রতি সম্মানবোধ কমতে থাকে, যা পরিণত বয়সে নানা সমস্যা সৃষ্টি করে
ধৈর্যের অভাব দেখা যায়
আগ্রাসী মনোভাব তৈরি হতে পারে
পরার্থপরতার শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়
কিছু আবেগ চেপে রাখার শিক্ষা পাওয়ার কারণে আবেগের বেহিসাবি বা অস্বাভাবিক বহিঃপ্রকাশ ঘটে
কিশোর বয়সে আচরণ উদ্ধত হয়ে যেতে পারে
নেশায় আসক্ত হয়ে যেতে পারে, বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে যেতে পারে
ব্যক্তিত্বের সমস্যা হতে পারে, পরিণত বয়সে যা তার পারিবারিক ও পেশাগত জীবনকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে
বাবা-মায়েরা যা করবেন
প্রত্যেক শিশু তা মেয়ে বা ছেলে যা-ই হোক না কেন, তাদের পারিবারিক ও সামাজিক অনুশাসনের মধ্যে বেড়ে উঠতে হবে। তাদের শিখতে হবে নৈতিকতা আর পারিবারিক সংস্কৃতি। পাশাপাশি ছেলে-মেয়ে সবার জন্য নিরাপত্তার বিষয়টিও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাবা-মাসহ অভিভাবকদের একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে বেশি মনোযোগ দিতে গিয়ে ছেলে ও মেয়ের মধ্যে যেন তাঁরা কোনো ‘নিয়মের বৈষম্য’ তৈরি না করে ফেলেন। কিছু বিষয় ছেলেদের জন্য আলাদা আর মেয়েদের জন্য আলাদা হতে পারে কিন্তু আলাদা করতে গিয়ে তাঁরা যেন সন্তানের ব্যক্তিত্বের বিকাশকেÿক্ষতিগ্রস্ত করে না ফেলেন।
বাবা-মায়েরা নজর দিতে পারেন
একই পারিবারিক নিয়ম
পরিবারের জন্য ঘোষিত নিয়মগুলো সবার জন্য সমান হতে হবে। যেমন পড়ার সময়, টিভি দেখার সময়—ছেলে, মেয়ে, বাবা, মা সবার জন্য সমান হতে হবে। ‘তোমার পরীক্ষা, যাও পড়তে যাও’ বলে নিজেই টিভি দেখা উচিত নয়।
তুলনা নয়
‘তুমি ছেলে, এটা তোমাকেই করতে হবে’ বা ‘তুমি মেয়ে, এই কাজ তোমার জন্য নয়’ এ ধরনের সুনির্দিষ্ট বাক্য ব্যবহার করে তুলনা করা চলবে না।
সামাজিকতা
মনে রাখতে হবে যে সামাজিকতার শিক্ষা সবার জন্যই। ফলে কেবল মেয়েশিশুকে ‘আদব-কায়দা’ শেখালেই হবে না, ছেলেশিশুকেও সমানভাবে সামাজিক রীতিনীতি শেখাতে হবে। মনে রাখতে হবে, ছেলেটিকেও সমাজে ভদ্রজনোচিত আচরণ করা শিখতে হবে।
সামাজিক ‘মিথ’ থেকে দূরে থাকুন
‘মেয়েরা অট্টহাসি হাসতে পারবে না’, ‘ছেলেরা কাঁদতে পারবে না’ ইত্যাদি সামাজিক মিথ থেকে দূরে থাকুন। শিশুদের সমানভাবে বেড়ে উঠতে দিন।
নিরাপত্তা সবার জন্য
একটা সাধারণ ধারণা আছে, মেয়েশিশুদের জন্যই নিরাপত্তা দিতে হবে, ছেলেশিশুরা সব সময়ই নিরাপদ। কিন্তু পরিসংখ্যান বলে, ছেলেশিশুরাও মানসিক-শারীরিক-যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে এবং সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। তাই ছেলেশিশুদের নিরাপত্তার জন্যও নিয়ম তৈরি করুন।
মেয়ের বিষয়ে পরিবারের ছেলেকে সম্পৃক্ত করা
পরিবারে কন্যাসন্তান থাকলে তার যত্ন, নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়ে তার ভাইকে (তা ছোট বা বড় যা-ই হোক না কেন) সম্পৃক্ত করুন। তাতে করে সে ভবিষ্যতে মেয়েদের প্রতি সম্মান দিতে শিখবে।
পরিবারে মাকে সম্মান দিন
সন্তানদের সামনে কখনোই তাদের মায়ের প্রতি অবমাননাকর আচরণ করা যাবে না। বাবা যদি এমনটা করেন, তবে ছেলেশিশুর মধ্যে আগ্রাসী আচরণ আর মেয়েশিশুর মধ্যে হতাশা তৈরি হয়।
পোশাক নির্বাচন
পোশাক নির্বাচনের বিষয়ে ছেলেরা অবারিত স্বাধীনতা পেয়ে থাকে, যা তার পরিবারের মেয়ের মনে হতাশা তৈরি করতে পারে। পোশাক নির্বাচনে ছেলে-মেয়ে সবাইকে সমান সুযোগ দেবেন অথবা একই ধরনের নিয়ম সবার জন্য আরোপ করবেন।
অতিরিক্ত স্বাধীনতা নয়
অনেক সময় বৈষম্যমূলকভাবে ছেলেশিশুকে অতিরিক্ত স্বাধীনতা দেওয়া হয়। তার হাতে বেশি টাকা দেওয়া হয়: ‘ও ছেলে মানুষ, কত কাজে টাকা লাগতে পারে’, ‘ও তো ছেলে, রাত করে বাইরে যেতেই পারে’ ইত্যাদি। কিন্তু এই স্বাধীনতা ছেলেশিশুটির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ আর তার বোনের জন্য হতাশার কারণ হতে পারে। ছেলেটির জন্য ঝুঁকি থাকে মাদক আর অপরাধে জড়িয়ে পড়ার আর মেয়েটির জন্য হতাশা থেকে বিষণ্নতা আর ব্যক্তিত্বের সমস্যা হতে পারে।
উৎসবে বৈষম্য নয়
জন্মদিনসহ নানা উৎসবে ছেলে বা মেয়েশিশুর বিষয়ে বৈষম্য করা যাবে না। ‘ছেলেরা, বাইরে বন্ধুবান্ধব নিয়ে জন্মদিন পালন করতেই পারে’ আর ‘মেয়েদের বাসার বাইরে জন্মদিন-টিন পালন করা যাবে না’, এমনটা যেন না হয়। সামাজিক অবস্থা, পারিবারিক সংস্কৃতি ও নিরাপত্তার বিষয়কে মাথায় রেখে ছেলে-মেয়ে সবার জন্য একই নিয়ম মেনে চলার চেষ্টা করতে হবে।

ভালো লেগেছে